মুমিনের প্রকৃত পুরস্কার হলো মহান আল্লাহর সান্নিধ্য বা দিদার। আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করার মাধ্যম সুনিশ্চিত জান্নাত লাভ করবে মুমিন। তাকওয়া অবলম্বনকারীদের সামনে জান্নাতকে খুব কাছাকাছি উপস্থাপন করা হবে। তাদের বলা হবে-এই সেই জান্নাত যার ওয়াদা তোমাদের সঙ্গে করা হয়েছিল।
আল্লাহভীতির গুরুত্ব
আল্লাহভীতি আদর্শ মানুষের জীবনের মূলভিত্তি। আল্লাহভীতির অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শন এবং তার সম্পর্কে জেনে তাকে ভয় করা তার আদেশ পালন করা এবং তার নিষেধ থেকে বিরত থাকা। কুরআনের প্রথম আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন এ কুরআন মুত্তাকির পথপ্রদর্শক। রমজানের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পার। রমজান ও রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাঝে তাকওয়া বা খোদাভীতির যোগ্যতা অর্জন করানো। তাকওয়া ছোট্ট একটি গুণ। এটি হলো প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহতাআলাকে ভয় করা।
ভয়ের সংজ্ঞা
খাওফুন আরবি শব্দ। এর অর্থ ভয়। তবে এর আভিধানিক অর্থ হলো কাক্সিক্ষত বিষয় হাতছাড়া এবং অবাঞ্ছিত বিষয়ে পতিত হওয়ার আশঙ্কায় অন্তরে অনুভূত সৃষ্ট এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার নাম ভয়। কেউ কেউ ভয়ের সংজ্ঞায় লিখেছেন আল্লাহর প্রতাপ ও বড়ত্বের কারণে অন্তর প্রকম্পিত হওয়া। ইমাম গাজজালি (রহ.) ভয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন ভবিষ্যতে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কায় অন্তরে এক প্রকার জ¦লন ও পোড়নের নাম ভয়। তিনি আরেক স্থানে লিখেছেন ভয় হলো একটি চাবুক যা বান্দাকে সৌভাগ্যশীলতার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
ভয়ের হকিকত
এখানে ভয় দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহকে ভয় করার অর্থ হলো তার শাস্তিকে ভয় করা। ভয় তখনই সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হবে যখন আল্লাহর সব আদেশ মানা হবে এবং সব নিষেধ বর্জন করা হবে। এ হিসেবে বলা যায় আল্লাহর ভয়ের প্রকৃত অর্থ হলো আল্লাহর আজাব ও গজবের কথা মনে করে তার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করা।
দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য লাভ
আল্লাহভীতি অবলম্বনকারী বান্দা আল্লাহর পথে চলার সঠিক নির্দেশনা পায়। সে এ পথে সুদৃঢ় থাকে। এর ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য লাভ করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন নিশ্চয়ই মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে সফলতা। (সুরা নাবা : ৩১) আল্লাহভীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার অমিয় নূর বা জ্যোতি লাভ করে। ফলে তার অন্তর পবিত্র আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। আল্লাহতায়ালা আল্লাহভীরু লোকদের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহভীতি মানুষকে সৎ, সুশীল, শোভন ও চরিত্রবান করে গড়ে তোলে। যার ফলে আল্লাহভীরু মানুষ সমাজে সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়। আল্লাহভীরু মুমিন বান্দা কেয়ামতের দিনে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। সেদিন সাত শ্রেণির লোককে আল্লাহ তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদের একজন হলেন ওই ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় পদমর্যাদা সম্পন্ন রূপসী নারী অশ্লীল কাজের জন্য আহ্বান জানায় কিন্তু সে এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করে যে আমি আল্লাহকে ভয় করি। হাদিসে বর্ণিত সপ্তম ব্যক্তি হচ্ছে যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে (জিকির করে) ফলে তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।
আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত লাভ
যারা সব সময় আল্লাহকে ভয় করে চলে তারাই মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। আল্লাহভীতির কারণে তারা আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত লাভ করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন নিশ্চয়ই যারা তাদের প্রভুকে না দেখে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার। (সুরা মুলক : ১২) তাকওয়া বা আল্লাহভীতি হলো ইবাদত কবুলের মাপকাঠি। তাই আল্লাহভীতি অবলম্বনকারী বান্দার ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন। কেননা আল্লাহ বলেন বরং তোমাদের তাকওয়াটুকুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। (সুরা হজ : ৩৭) এ ছাড়া যারা আল্লাহকে ভয় করে কেয়ামতের দিন তাদের কোনো ভয় থাকবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন আমার মর্যাদার কসম। আমি আমার বান্দার মাঝে দুটি ভয় এবং দুটি নিরাপত্তা একত্র করি না। যে বান্দা এ দুনিয়ায় আমাকে ভয় করবে আমি তাকে কেয়ামতের দিন নিরাপত্তা দেব। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে আমাকে ভয় করবে না পরকালে আমি তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করব।
জান্নাত লাভ নিশ্চিত করে
আল্লাহভীতি বান্দার জান্নাত লাভ নিশ্চিত করে। একবার রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন কাজের জন্য মানুষ অধিক জান্নাতে প্রবেশ করবে ? উত্তরে তিনি বলেন আল্লাহর ভয় এবং সুন্দর চরিত্র। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন আর যে স্বীয় প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল। (সুরা নাজিআত : ৪০-৪১) মহান আল্লাহ আরও বলেন যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে আল্লাহকে ভয় করে এবং তার ভয়ে গুনাহ হতে বেঁচে থাকে তারাই মূলত সফলকাম। (সুরা নুর : ৫২) আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন আর যে ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) তার প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হতে ভয় করে তার জন্য রয়েছে দুটি জান্নাত। (সুরা আর রাহমান : ৪৬) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আপন প্রভুর সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে যার অন্তরে আল্লাহর ভয় রয়েছে এবং নির্জনে থাকাকালীন তার অন্তরে কোনো গুনাহের সাধ জাগলে সঙ্গে সঙ্গে সে আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং ভাবে আমাকে তো একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। এ কথা চিন্তা করে সে গুনাহের ইচ্ছা ত্যাগ করে। এমন ব্যক্তির জন্য রয়েছে দুটি জান্নাত।
আল্লাহভীতির ফলাফল
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। তাই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তার নির্দেশ পালন করা এবং তার শক্তি ও শাস্তি নিয়েও চিন্তা করা উচিত। এতে অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করা আখেরাতে নিরাপত্তার মাধ্যম। এ ভয় উভয় জগতে সফলতা ও কামিয়াবির পথ। আল্লাহভীতি পরিপূর্ণ ইমানের দলিল। এ ভয় ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য আত্মার পরিশুদ্ধি এবং কলবের পবিত্রতার নির্দেশক। আল্লাহতায়ালা আমাদের অন্তরে তার ভয় জাগ্রত করার তওফিক দান করুন।
তাকওয়ার গুরুত্ব
তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন মানব জীবনের অপরিহার্য বিষয়। তাকওয়ার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অন্তর। মুমিন তার অন্তরে তাকওয়ার বীজ বপন করার ফলে তাঁর অন্তর সবসময় তরতাজা থাকে।এর মাধ্যমে মুমিন জান্নাত লাভের আশাও করেন। যে ব্যক্তির মধ্যে তাকওয়া থাকে তাকে মুত্তাকী বা মুমিন বলে। মানুষের সব ধরনের সৎগুনাবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাকওয়া। একজন মুমিন পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গলের কাজে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। এর মাধ্যমে সে জান্নাত লাভের পথ সুগম করে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন : হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর। (সূরা আলে ইমরান : ১০২) তাকওয়া অবলম্বন বিষয়ে মানবতার মুক্তির দিশারী দোযাহানের বাদশাহ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : দুটি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না একটি চোখ যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর অপরটি হলো আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত অবস্থায় রাত্রি যাপন করে। আমরা জানি তাকওয়া শুধু জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয় না বরং তা জান্নাতে প্রবেশ করতেও সাহায্য করে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে হাকিমে বলেছেন : আর যে ব্যক্তি তাঁর রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নিজেকে কুপবৃত্তি খেকে বিরত রাখে তার জন্য রয়েছে জান্নাতের অবাসস্থল। যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা পরকালে সর্বোচ্চ নিরাপদে থাকবে। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা এ বিষয়ে বলেন : নিশ্চই মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে। (সূরা আদ দুখান আয়াত : ৫১) মুত্তাকী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বদা সম্মানিত হন। খোদাভীতি অর্জনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যায়। মুত্তাকীদের সম্মাননার বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন : তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। (সূরা হুজরাত : আয়াত : ১৩)
আল্লাহর নৈকট্য লাভ
এছাড়াও আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভের অন্যতম মাধ্যম তাকওয়া। তাইতো আল্লাহ কুরআনে বলেছেন : নিশ্চই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কোন মানুষই ততক্ষন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না যতক্ষণ না সে আল্লাহর নির্ধারিত রিজিক লাভ করবে। আল্লাহতায়ালা যার জন্যে যে রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন তা শীঘ্র হোক বা দেরিতে হোক সেটি সে লাভ করবেই।
দোয়া
শেষপ্রান্তে এসে আল্লাহতায়ালার কাছে আবেদন-হে আমাদের সৃষ্টিকর্তা রিজিকদাতা আমাদেরকে হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করে দেন হারাম উপার্জন থেকে বাঁচার তাওফিক দেন। আমীন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট