যুক্তরাজ্যের লন্ডনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মালিকানাধীন তিনটি আবাসন কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঋণ খেলাপির কারণে কোম্পানিগুলোর দায়-দেনা নিষ্পত্তি এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে আদালতের নির্দেশে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দেউলিয়া হওয়া প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেড, জারিয়া প্রপার্টিজ লিমিটেড এবং জেবা প্রপার্টিজ লিমিটেড। কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন করা হয় যথাক্রমে ২০২১ সালের ২১ জুন (জেবা ও জারিয়া) এবং ২১ জুলাই (সাদাকাত)। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক ছিলেন সাইফুজ্জামান জাবেদ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ‘গ্রান্ট থর্নটন’-এর মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সাদাকাত, জারিয়া ও জেবা প্রপার্টিজ লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আবাসিক সম্পত্তির মালিক ও ব্যবস্থাপক। ঋণখেলাপির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশাসনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। প্রশাসকরা বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।’
ঋণ ১৮২ কোটি টাকা, সম্পদ ৫১৮ কোটি
২০২৫ সালের ২২ মে প্রতিষ্ঠান তিনটির দেউলিয়ার দায়ভার গ্রহণ করে যুক্তরাজ্যের প্রফেশনাল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ‘গ্রান্ট থর্নটন ইউকে অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড ট্যাক্স এলএলপি’। হাই কোর্ট অব জাস্টিস, বিজনেস অ্যান্ড প্রপার্টি কোর্টস ইন বার্মিংহামের আদেশে প্রশাসকের দায়িত্ব পান অলিভার হঞ্চ ও হিনা প্যাটেল। তারা বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ, দায় ও ভাড়াটিয়াদের সাথে যোগাযোগসহ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন।
জানা যায়, কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৭ মিলিয়ন পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫১৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় ১৮২ কোটি টাকা, যা মূলত ব্রিটিশ আরব কমার্শিয়াল ব্যাংকের কাছে বকেয়া।
দুই মাসে তিন কোম্পানি
ব্রিটিশ কোম্পানি রেজিস্ট্রি হাউজের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের কোম্পানি নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ২১ জুন একই দিনে জাবেদের মালিকানাধীন জেবা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও জারিয়া প্রপার্টিজ লিমিটেডকে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন দেয়। এর ঠিক এক মাস পর ২০২১ সালের ২১ জুলাই সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেড নিবন্ধন পায়।
এই তিন কোম্পানিই যুক্তরাজ্যভিত্তিক আবাসন খাতের উন্নয়ন, ক্রয়-বিক্রয় ও লিজ সংক্রান্ত কাজ করতো। দেউলিয়ার ঘোষণার পর কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্ট এবং সমস্ত লেনদেন বর্তমানে প্রশাসকের অধীনে চলে গেছে।
দেউলিয়াত্বের নেপথ্যে ব্যাংকঋণ
দেউলিয়া আবেদনের নথিপত্র অনুসারে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল আর্থিক সংকট তৈরি হয় ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে। বিশেষ করে ব্রিটিশ আরব কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করায় চাপ তৈরি হয়। কয়েক দফা সময় নেওয়ার পরও অর্থ ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর দেউলিয়াত্ব দাবি করে।
বিদেশে ৫৭৫০ কোটি টাকার সম্পদ
গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার আগে কিংবা পরে সাইফুজ্জামান জাবেদ ভারত হয়ে লন্ডনে চলে যান বলে জানা গেছে। সর্বশেষ লন্ডনে তার অবস্থান শনাক্ত করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারে সর্বশেষ ভূমিমন্ত্রী ছিলেন এবং চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইসঙ্গে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যা ছিলেন তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী। জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির বিরুদ্ধেও বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে সাইফুজ্জামান জাবেদের সম্পত্তি নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের (আই-ইউনিট) অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নসে’ বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা) মূল্যের সম্পদ কিনেছেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টির বেশি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সাইফুজ্জামান জাবেদ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের (প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা) বাড়িতে বসবাস করছেন।
সাইফুজ্জামান জাবেদ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক। ওই সম্পত্তির মূল্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। তার স্ত্রী রুকমিলা জামান দুবাইয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক।
সরকারি তদন্তের অন্যতম টার্গেট
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়। এরপর থেকে অন্তর্বতী সরকার বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ উদ্ধারে তদন্ত করছে। এই তদন্তের অন্যতম টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামান বিশ্বজুড়ে ৬০০টিরও বেশি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক।
গত বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-কে চিঠি দিয়ে সাইফুজ্জামান, তার স্ত্রী রুখমিলা জামান, মেয়ে জেবা জামান এবং দুই ছেলে তানাইম জামান চৌধুরী ও সাদাকাত জামান-এর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য চেয়েছিল দুদক। এর আগে ওই বছরের ১২ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুখমিলা জামান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার নির্দেশ দেয়।
ব্রিটিশ এমপির চিঠি
গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ সংস্থাকে (এনসিএ) চিঠি দেন দেশটির ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আপসানা বেগম।
চিঠিতে এমপি আপসানা বেগম জানান, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কর জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংস্থাটি দাবি করেছে যে, তিনি যুক্তরাজ্যে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছেন। এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি এবং ইউকে কোম্পানি হাউসের রেকর্ডগুলোর বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো ১৫ কোটি পাউন্ডেরও বেশি মূল্যের কমপক্ষে ২৮০টি সম্পত্তি অর্জন করেছে। আল-জাজিরার তদন্তে জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী আমার নির্বাচনী এলাকা পপলার ও লাইমহাউজে ৭৪টি সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
সিপি