দারিদ্র্য ঘোচাতে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার অপরিহার্য ভূমিকা

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এটি মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসলাম মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মানবতার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। ইসলাম এই সমস্যা সমাধানে যাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছে। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না থেকে দরিদ্রদেরও তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়। একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে ধনী মুসলমানদের জন্য তাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের মাঝে বণ্টন করা ফরজ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে আয়বণ্টনের বৈষম্য হ্রাস পায় এবং অসহায় মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭)

যাকাতের মূল উদ্দেশ্য

যাকাতের প্রধান লক্ষ্য হলো গরিব-দুঃখীদের অভাব দূর করে একটি বৈষম্যহীন ও সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা। যাকাত সমাজে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে। এটি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পদের বৈষম্য দূর করে। ইসলামী অর্থনীতি একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় হিজরিতে ধনীদের উপর যাকাত ফরজ করা হয়েছিল দরিদ্রদের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। পবিত্র কুরআনে যাকাতের খাতগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: “সাদকা (যাকাত) শুধুমাত্র ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬০)

কিয়ামতের দিন সম্পদের হিসাব

কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে:
১. জীবন কোন পথে ব্যয় করেছো?
২. যৌবন কীভাবে কাটিয়েছো?
৩. আয় কীভাবে অর্জন করেছো?
৪. সম্পদ কীভাবে ব্যয় করেছো?
৫. ইসলাম সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান কতটা বাস্তবায়ন করেছো?
এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে দুটি সরাসরি অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। ইসলাম সম্পদের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে, যাতে কেউ অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন বা ব্যয় না করে। যাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়, যাতে ধনীরা আরও ধনী এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র না হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের মতো কার্যকর কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেই। ইসলামী সমাজে যাকাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা এবং এটি ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম।

যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

যাকাত হতদরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করে। নবী করিম (সা.) তাঁর সমগ্র জীবন দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আরব সমাজকে একটি স্বাবলম্বী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা। যাকাত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যাকাত ইসলামের সেতু।” ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের ২.৫% যাকাত হিসেবে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করলে গরিবরা দারিদ্র্যের কষ্ট থেকে মুক্তি পায়। যাকাতের মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত, এতিম, বিধবা ও অক্ষম ব্যক্তিরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। যদি যাকাত সঠিকভাবে আদায় ও বণ্টন করা হয়, তাহলে সমাজে কোনো ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন বা আশ্রয়হীন মানুষ থাকবে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাদের সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।” (সূরা আল-জারিআত, আয়াত: ১৯)

যাকাতভিত্তিক অর্থনীতির সাফল্য

ইসলামী ইতিহাসে যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি মহানবী (সা.)-এর সময়ে এবং খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মুসলিম উম্মাহকে একটি সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের হক নির্ধারণ করেছেন।” বর্তমানে মুসলিম সমাজের অসহায়, এতিম ও গরিব মানুষরা অর্ধাহারে-অনাহারে জীবনযাপন করছে। ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এসব মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

যাকাতের বাধ্যতামূলকতা ও সামাজিক দায়িত্ব

ইসলামে যাকাত একটি ফরজ ইবাদত, যা আর্থিক ইবাদতের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন ও হাদিসে বারবার যাকাত আদায়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যের শিকার, এবং যাকাত এই সমস্যা সমাধানের একটি কার্যকর পন্থা। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব, যা দিয়ে বছরে দুই লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। তাই ইসলামী বিধান অনুযায়ী যাকাত আদায় ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা

আল্লাহ তাআলা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন এবং এটি আদায় না করাটা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যাকাতের অর্থ দরিদ্র, অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষের প্রাপ্য। ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। আসুন আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে মানবতার কল্যাণ সাধন করি এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm