দুবাইয়ের জেলে এখনও বন্দি চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক রেমিট্যান্সযোদ্ধা
একই ঘটনায় মুক্ত ১৮৯, বাকিরা কেন এখনো বন্দি?
২০২৪ সালের জুলাই। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভে নামেন কয়েকশত প্রবাসী বাংলাদেশি। সেই ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর জেরে শতাধিক রেমিট্যান্সযোদ্ধা গ্রেপ্তার হন। সময় গড়িয়ে প্রেক্ষাপটও পাল্টেছে। ওই ঘটনায় আটক ১৮৯ জনকে ইতিমধ্যে মুক্তি দিয়েছে আমিরাত কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আজও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৫০ জন প্রবাসী বন্দি আছেন দুবাইয়ের হাই-সিকিউরিটি আল সদর কারাগারে।
চট্টগ্রাম থেকেই সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার, অথচ এখনো অবহেলায় প্রবাসীরা
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখনো বন্দি থাকা বেশিরভাগই চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে রাঙ্গুনিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ির অনেক প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছেন— বোয়ালখালী পশ্চিম কধুরখীলের শহিদুল আমিন (পাসপোর্ট: EG0091443), লোহাগাড়া আমিরাবাদের মিজানুর রহমান (পাসপোর্ট: A08329983), রাঙ্গুনিয়া সরফভাটার সাইফুল ইসলাম ও রহমত উল্লাহ (পাসপোর্ট: যথাক্রমে A14125383, A14266803), ফটিকছড়ি হারুয়ালছড়ির জাহিদুল ইসলাম (পাসপোর্ট: A00527006), সাতকানিয়ার নুর হাসান, চট্টগ্রাম নগরের সোহেলসহ আরও অনেকে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের জেলা থেকেও বন্দি আছেন অনেকে। এমন ২৫ জনের নামের তালিকা দিয়েছে ‘জুলাই আন্দোলনে জেলবন্দি রেমিট্যান্স যোদ্ধা পরিবার’ সংগঠনটি। এদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা বুড়িচংয়ের মোহাম্মদ হাসান, লক্ষ্মীপুর রামগঞ্জের শাহাদাত হোসেন (১) ও শাহাদাত হোসেন (২), কুমিল্লা নাসিরনগরের মন্টু মিয়া, মুদাফপুরগঞ্জের আমান উল্লাহ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণপাড়ার মাকসুদ আলম সরকার, নোয়াখালী, সেনবাগের জাকের হোসেন রনি, কুমিল্লা নাঙ্গলকোটের শাহাদাত হোসেন, ফেনী দাগনভুইয়ার শাহাদাত হোসেনসহ আরও অনেকে।
এক ফোনেই মুক্ত ১৮৯ জন, বাকিদের কেন অবহেলা?
২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করেন। ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা তাকে অনুরোধ করেন ১৮৯ বাংলাদেশিকে ক্ষমা দিতে। এরপর ১১৪ জনকে মুক্তি দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
‘দেশের জন্য আন্দোলন করে শাস্তি পেল প্রবাসীরা’
বন্দিদের স্বজনেরা বলছেন, প্রথম দফায় যেভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তি মিলেছিল, পরের ধাপে আটক হওয়াদের জন্য তেমন কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
বোয়ালখালীর শহিদুল আমিনের স্ত্রী রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দেশে ফিরতে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হন। তখনই জানি, তার নামে মামলা আছে ‘জুলাই আন্দোলনের।’
ফটিকছড়ির জাহিদুল ইসলামের ভাই রায়হান বলেন, ‘দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল ভাইটা, এখন তার খবর পর্যন্ত নেয় না সরকার।’
এনসিপি নেতার কাছে স্বজনদের আকুতি
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর কাছে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান স্বজনেরা। তিনি এ বিষয়ে সরকারকে জানানোর আশ্বাস দেন। এনসিপির মহানগর নেতা মোহাম্মদ আতিক বলেন, ‘চট্টগ্রামের যেসব ভাইরা আটকা পড়েছেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য।’
সরকারি দপ্তরগুলোর দায়িত্বহীনতা প্রশ্নবিদ্ধ
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান জানান, ‘আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবু বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে পাওয়া না গেলেও তার একান্ত সচিব সারওয়ার আলম বলেন, ‘আরব আমিরাতের কর্তৃপক্ষ তার দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আলাদাভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এদিকে আমিরাতে নিযুক্ত শ্রম কাউন্সিলর লুৎফুন নাহার নাজীম বলেন, ‘আমরা বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করেছি।’
কারা মুক্ত, কারা বন্দি—জানেই না সরকার!
বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, তাদের কাছে রয়েছে ২০ জনের তালিকা। মন্ত্রণালয়ের হিসেবে সেই সংখ্যা ২৭। অথচ পরিবারগুলো বলছে, শুধু আল সদর জেলেই ২৫ জন বন্দি আছেন। অনেকে রয়েছেন অন্য জেলেও। এই পরিসংখ্যানের গরমিলই মুক্তির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিমানবন্দরে আটক হওয়ার আশঙ্কা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
সূত্র জানায়, আন্দোলনকারীদের নাম ও পাসপোর্ট নম্বর ইমিগ্রেশন ডেটাবেইসে সংরক্ষিত রয়েছে। ফলে যারা দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, তাদের বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘সরকার যদি দ্রুত এসব তথ্য মুছিয়ে না নেয়, তাহলে এই প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।’
জেজে/সিপি