চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনলাইন সংস্করণে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে ‘অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর’ আখ্যা দিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। সম্পাদকের ইমেইলে চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. মো. শাহাদাত হোসেন শুভ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে বাঘের খাবারের টাকায় চট্টগ্রামের ডিসির ‘পিকনিক’, চিড়িয়াখানার কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একাধিক অসত্য ও তথ্যগত ভুল রয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়, সংবাদে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ১ কোটি টাকা এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে এফডিআর করা হয়েছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এই অর্থ এফডিআর করা হয়েছে এনআরবি ব্যাংকে, যা সম্পূর্ণ আলাদা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
তদুপরি, ‘বাঘের খাবারের টাকায় ডিসির পিকনিক’ শিরোনামটিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে বলা হয়, বর্তমান জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কোনো পিকনিক বা এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি।
প্রতিবাদপত্রে আরও জানানো হয়, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ঝন্টু আলীর চিকিৎসা খাতে যে অর্থ সহায়তার কথা বলা হয়েছে, তা মানবিক বিবেচনায় দেওয়া হয়, কারণ তিনি দূরারোগ্য লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া যেসব খরচের উল্লেখ করা হয়েছে, তা চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার নির্বাহী কমিটির অনুমোদনক্রমে বিধিমোতাবেক ব্যয় করা হয়েছে।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। ফলে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনের মতো বিভিন্ন উদ্যোগে অনুদান দিয়ে থাকে। বর্তমান জেলা প্রশাসকের দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে চিড়িয়াখানার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয় প্রতিবাদপত্রে।
প্রতিবাদপত্রের শেষাংশে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হলো সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। কিন্তু বিভ্রান্তিকর শিরোনাম ও ভুল তথ্যের মাধ্যমে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ফলে পাঠকের মাঝে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটির সংশোধনী প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে যথাযথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের আহ্বান জানিয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদপত্রে দাবি করা হয়েছে, ‘বাঘের খাবারের টাকায় ডিসির পিকনিক’ শিরোনামে চট্টগ্রাম প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বিভ্রান্তিকর, অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে বাস্তবতা হলো, এই প্রতিবাদপত্রটি সংবাদে উত্থাপিত তথ্যগুলোর কেবল খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়েছে—পুরো বিষয়টি নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়নি।
প্রথমত, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কোটি টাকার এফডিআর বিতর্কে কেবল ব্যাংকের নাম ভুল হয়েছে দাবি করে পুরো বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অর্থ রাখা হয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে নয়, বরং এনআরবি ব্যাংকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—সেটা এনআরবি ব্যাংকে হয়ে থাকলে সেটিও একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক— যা মূলত আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থপাচারের দায়ে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী মাহতাবুর রহমান নাসিরের নেতৃত্বাধীন ব্যাংকটিতে সরকারি তহবিল রাখার যৌক্তিকতা কী? অসর্তকতাবশত ব্যাংকের নাম ভুল হলেও—নীতিগত ঝুঁকি, তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং এই সিদ্ধান্তের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংকটে ধুকতে থাকা এনআরবি ব্যাংক এখন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার এফডিআরের টাকাও দিতে পারছে না। এর প্রতিকার চেয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে বলেও জানা গেছে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদপত্রে জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের ‘পিকনিক খরচ’ অস্বীকার করা হলেও, চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা চিড়িয়াখানার নথিপত্র বলছে—২৪তম বিসিএস অ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী ও পিকনিক উপলক্ষে চিড়িয়াখানার তহবিল থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ দুই দফায় ২ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। এটি ‘পিকনিকের খরচ’ না হলে—তবে কী?
তৃতীয়ত, প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, রংপুরের সহকারী কমিশনার ঝন্টু আলীর চিকিৎসায় অনুদান মানবিক কারণে দেওয়া হয়েছে। মানবিকতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—একটি প্রাণী কল্যাণকেন্দ্রিক তহবিল থেকে কেন ব্যক্তিগত চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে? এটি কি সেই তহবিলের প্রস্তাবিত ব্যয়ের আওতাভুক্ত? যদি না হয়, তাহলে কেবল ‘মানবিকতা’র অজুহাতে অর্থ ব্যয়ের বৈধতা দেওয়া যায় না।
এছাড়া চিড়িয়াখানার অর্থ থেকে জাতীয় দিবস উদযাপন, ডিসি পার্ক রং করানো বা সামাজিক সংগঠনকে অনুদানের ব্যয়ের যথার্থতা নিয়ে প্রতিবাদপত্রটি নীরব। বরং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ্ খানের পিতা-মাতার নামে গঠিত ফাউন্ডেশনেও ১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে ডিসি ফরিদা খানমের স্বাক্ষরে—এই তথ্যটিও প্রতিবাদপত্রে উপেক্ষিত। প্রশ্ন হলো এই অনুদান কোনো নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়েছিল কি? না হলে, একে কি স্বেচ্ছাচারিতা বলা যাবে না?
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বাবলম্বী এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু অনুদান দেওয়া কি তহবিলের মৌল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? দর্শনার্থীদের প্রবেশমূল্য থেকে অর্জিত কোটি কোটি টাকার আয় কি কেবল জনপ্রশাসনের আভ্যন্তরীণ পছন্দ-অপছন্দ পূরণে ব্যয় হবে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—প্রতিবাদ জানিয়ে কিংবা সংবাদপত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া যায় না। এসব ব্যয় হয়তো আইনের সরাসরি লঙ্ঘন নয়, তবে তা নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য।
সুতরাং চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জনকল্যাণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে প্রতিবাদ নয়—প্রয়োজন তদন্ত, ব্যাখ্যা এবং যথাযথ জবাবদিহি।