বাঘের খাবারের টাকায় চট্টগ্রামের ডিসির ‘পিকনিক’, চিড়িয়াখানার কোটি টাকা এস আলমের ব্যাংকে
নজিরবিহীন অনুদান, বিতর্কিত খাতে চিড়িয়াখানার টাকা
দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ও দর্শনার্থীবহুল চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা এখন আর বাঘ-ভাল্লুকের জন্য নয়, বরং কোটি টাকার তহবিল থেকে বিতর্কিত ব্যয় নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যে অর্থ যাওয়ার কথা ছিল প্রাণীকল্যাণ ও চিড়িয়াখানার উন্নয়নে, সেই তহবিল থেকেই খরচ হচ্ছে পিকনিকের বিজ্ঞাপন, দিবস উদযাপন আর ব্যক্তিগত অনুদানের নামে লাখ লাখ টাকা।

সরকারি নথি বলছে, এসব ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম। তার সিদ্ধান্তে ‘চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা উন্নয়ন ও প্রাণীকল্যাণ তহবিল’ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আইন সরাসরি লঙ্ঘন না করলেও এসব ব্যয় নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, নজিরবিহীন এবং স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, অপচয়ের এই প্রবণতা চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকে অবস্থিত চিড়িয়াখানার ভবিষ্যতের জন্য এক বড় হুমকি।
স্বচ্ছতা নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন
১৯৮৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২ একর জায়গা নিয়ে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা বর্তমানে ১০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। বর্তমানে ৬৮ প্রজাতির ৫২০টি প্রাণী দেখতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন হাজার দর্শনার্থী সেখানে যান। চিড়িয়াখানার বার্ষিক আয় ৭ কোটি টাকারও বেশি।
এই বিপুল আয় থেকে খরচ বাদে উদ্বৃত্ত অর্থ একটি নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়, যা মূলত প্রাণী সংগ্রহ, আবাসন উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক একাধিক নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই তহবিল থেকে নানা খাতে অনুদান ও বিজ্ঞাপনের নামে বিতরণ করা হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। যদিও চিড়িয়াখানার পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের পদাধিকার রয়েছে, তবুও খরচের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি অনুসরণ না করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে বড় প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। এমন স্বেচ্ছাচারিতার কারণে চিড়িয়াখানার ভবিষ্যতই হুমকিতে পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
নজিরবিহীন অনুদান, বিতর্কিত খাতে চিড়িয়াখানার টাকা
নথি অনুযায়ী, ডিসি ফরিদা খানম তার নিজস্ব ২৪তম বিসিএস প্রশাসন অ্যাসোসিয়েশনের গ্র্যান্ড পুনর্মিলনী ও পিকনিক উপলক্ষে দুই দফায় বিজ্ঞাপন বাবদ চিড়িয়াখানার তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এছাড়া রংপুরে কর্মরত শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনার ঝন্টু আলী সরকারকে ব্যক্তিগত অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা।
আরও বিতর্কিত ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে— বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য ৫ লাখ টাকা, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে আরও ৫ লাখ টাকা অনুদান। তবে বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ৫ লাখ টাকার অনুদানটি কার কাছে গিয়েছে, নথিতে তার কোনো উল্লেখ নেই।
নথিতে দেখা যায়, ঢাকা বিয়াম ফাউন্ডেশনে এসি বিস্ফোরণে হতাহতদের সহায়তায় ৩ লাখ টাকা অনুদান, বিভাগীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন বাবদ ৫০ হাজার টাকা, এইচএল ফাউন্ডেশন ফর সোশ্যাল এক্সিলেন্স-কে বিজ্ঞাপন বাবদ ১ লাখ টাকা এবং ডিসি পার্কে রং করায় ব্যয় হয়েছে আরও ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০৫ টাকা।
এই ব্যয়গুলো আইনের সরাসরি লঙ্ঘন না হলেও নজিরবিহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন চিড়িয়াখানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ব্যক্তিগত পছন্দের খাতে বাঘের খাবার!
চিড়িয়াখানার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা থাকলেও এই তহবিল থেকে জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে অনুদান বিতরণ করা হয়েছে।
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চিড়িয়াখানার তহবিল থেকে আগে এক টাকাও বাইরে যেত না। পুরো অর্থ উন্নয়ন ও প্রাণী সংগ্রহে ব্যয় হতো। তবে সাবেক ডিসি মোমিনুর রহমানের আমল থেকে শুরু হয় অনুদানের নামে তহবিল থেকে টাকা সরানোর রেওয়াজ।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘জাতীয় দিবস বা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তিগত পছন্দের খাতে অর্থ বিতরণে এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ভবিষ্যতে চিড়িয়াখানার সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
এস আলমের ব্যাংকে কোটি টাকার এফডিআর
তহবিল ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ২ কোটি টাকার মেয়াদী আমানত (এফডিআর) করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংকটাপন্ন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে রাখা হয়েছে ১ কোটি টাকা। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিতর্কিত ব্যাংকে সরকারি তহবিল রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল।
ডিসির আত্মপক্ষ
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘চিড়িয়াখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে আমার অনুদান দেয়ার অধিকার রয়েছে। আমি কখনোই অনৈতিক কিছু করিনি। রংপুরের এক সহকারী কমিশনার মারা যাওয়ায় তার পরিবারকে ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছি। অন্যান্য খরচও বিজ্ঞাপন ও অনুদান খাতে হয়েছে। তবে এর বাইরেও কিছু খরচ হয়েছে কিনা, তা আমার জানা নেই।’
তবে দীর্ঘদিন ধরে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংকটাপন্ন ব্যাংক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে এফডিআরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
যা বলছেন বিভাগীয় কমিশনার
চিড়িয়াখানার তহবিল থেকে ব্যক্তিগত অনুদান দেওয়া যায় কি না— সংবাদমাধ্যমের এমন প্রশ্নে বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে জানালে আমার করণীয় ঠিক করতে পারবো।’
সিপি