চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ, মামলা ঢাকায়: ‘জুলাইযোদ্ধা’র নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা, মুখোমুখি দুই সংস্করণ

সাদা স্ট্যাম্পের ফাঁদ পেতে ‘মামলাবাণিজ্যের’ নালিশ

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনে চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড়ে পুলিশের গুলিতে চোখ, মাথা ও মুখে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন এক তরুণ। তার নাম সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ। এরপর দীর্ঘ চিকিৎসা, আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা এবং সরকারিভাবে গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তি। কিন্তু সেই আত্মত্যাগী তরুণ এখন বিপাকে। কারণ তাকে ঘিরে দুই শহরে হয়েছে দুই মামলা।

একটি চট্টগ্রামে, যেখানে বাদী তিনি নিজেই। আরেকটি ঢাকায়, যেখানে বাদী হয়েছেন এমএ হাশেম রাজু নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে পরিচয় দেন ‘মানবাধিকারকর্মী’ হিসেবে এবং দাবি করেন এমদাদের ‘পক্ষ হয়ে’ তিনি মামলা করেছেন।

এক ব্যক্তি, একই ঘটনায়—দুই শহরে আহত হওয়ার দাবি ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে আড়ালের উদ্দেশ্য কী? কারা আছে এর পেছনে? মামলার বিবরণ, মোবাইল কল রেকর্ড এবং প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একাধিক অসঙ্গতি। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘ঢাকার মামলা’ শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং হয়ে ওঠতে পারে প্রতারণার আশঙ্কাজনক দৃষ্টান্ত।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মামলার ফারাক স্পষ্ট

গত বছরের আগস্টে চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসার মোড়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম শহরের খুলশী থানায় গত ১৭ জুন সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ একটি মামলা করেন, যাতে ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট চট্টগ্রামে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা, আন্দোলনের বিস্তারিত, অভিযুক্তদের নাম-ঠিকানা সবই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে। মামলায় আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ১৬৭ জনকে। এছাড়া আন্দোলন দমনে অর্থ ও মদদদাতা হিসেবে পিএইচপিসহ একাধিক শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারসহ হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। মামলার সহায়ক নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি, হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন, মেডিকেল সার্টিফিকেট, এমনকি মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড। যা প্রমাণ করে, ওই দুইদিন তিনি চট্টগ্রামেই ছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতেই ফুটে ওঠে ঢাকার মামলাটি সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত এবং বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ঢাকার মামলায় রাজুর ‘আষাঢ়ে গল্প’

চমকপ্রদভাবে এর তিন মাস আগে ঢাকায় এমএ হাশেম রাজু নামের এক ব্যক্তি ঢাকার আদালতে একটি মামলা করেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন নামে একটি সংগঠনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া এই ব্যক্তির দায়ের করা সেই মামলার আসামি সংখ্যা ২০১। মামলায় দাবি করা হয়, এমদাদ ৪ আগস্ট বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ঢাকার শাহবাগ মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন। রাজুর দাবি, তার উপস্থিতিতেই এমদাদ গুলিবিদ্ধ হন। এমনকি দাবি করা হয়, রাজুই আহত এমদাদকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামে নিয়ে যান।

এমদাদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি তো সেদিন চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হই। ঢাকায় ছিলামই না। অথচ আমার পক্ষ হয়ে মামলা করেছে এমন একজন, ওই সময় যাকে আমি চিনতামই না।’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, ওইদিন যে আমি ঢাকাতেই ছিলাম না, তার তথ্যপ্রমাণও সংরক্ষিত আছে। তাহলে রাজু কিভাবে আমাকে ঢাকা থেকে উদ্ধার করলেন?’

ঢাকায় গুলির মামলা, এমদাদ তখন চট্টগ্রামে!

গত ২০ মার্চ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রাজুর দায়ের করা মামলায় এমদাদকে গুলিবিদ্ধ দেখানো হয়েছে গত বছরের ৪ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে, ঢাকার শাহবাগ মোড়ে।

হাশেম রাজুর সেই মামলায় উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালে ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মামলার বাদি এমএ হাশেম রাজুর নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পরীবাগ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের মোড়ে পৌঁছালে আগে থেকে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্যরা একযোগে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ শুরু করে। তারা আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, হাতবোমা, পেট্রোলবোমা ও ককটেল নিক্ষেপসহ টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ে। এতে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, এমদাদের গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার ঘটনা কাছ থেকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন বাদি এমএ হাশেম রাজু। এ সময় তিনি আহত এমদাদকে উদ্ধার করে চিকিৎসার প্রচেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে তাকে নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে যান।

অথচ তার এমদাদের নিজস্ব বক্তব্য ও বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ অনুসারে, চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি ওইদিন বিকালে।

এমদাদের মোবাইল ফোনের সেলুলার লোকেশন (সিডিআর) বিশ্লেষণ করে ৪ ও ৫ আগস্ট তার অবস্থান চট্টগ্রামের খুলশী, নাসিরাবাদ ও পাঁচলাইশ এলাকায় শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সেই সময়ে ঢাকায় থাকতেই পারেন না।

এমদাদ বলেন, ‘যে সময় ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা বলছে, তখন আমি চট্টগ্রামে হাসপাতালের পথে। এক চোখে রক্ত, শরীর ভেঙে পড়ছে। ঢাকার শাহবাগে কিভাবে গুলি খেতে পারি আমি?’

কিন্তু যখন হাশেম রাজুকে জিজ্ঞেস করা হয়—সেই সময় এমদাদ ঢাকায় ছিলেন কি না, তখন হাশেম রাজু কিছুটা অপ্রস্তুত সুরে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা এমদাদকেই জিজ্ঞেস করেন।’

সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ

এই প্রতারণার পেছনে আরও ভয়াবহ গল্প উঠে এসেছে এমদাদের বক্তব্যে। তিনি জানান, ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এমএ হাশেম রাজু তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিজেকে মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দিয়ে চিকিৎসায় সহায়তা ও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন।

জুলাইযোদ্ধা এমদাদ বিস্তারিত উল্লেখ করে বলেন, সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহারের কথা বলে তার কাছ থেকে বেশ কিছু সাদা কাগজ ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন রাজু। সেসব স্বাক্ষর ব্যবহার করে নিজেই বাদি সেজে ঢাকার আদালতে মামলা করেন রাজু। এমনকি মামলায় তার যে ঠিকানাটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও সঠিক নয় বলে জানান এমদাদ।

এমদাদ অভিযোগ করেন, তাকে কোনো ধরনের উন্নত চিকিৎসা বা সরকারি পর্যায়ের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেননি রাজু। বরং তিনি স্থানীয় থানা পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারেন, রাজু তার পক্ষ হয়ে একটি মামলা করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাজু বলেন, ‘আমি চিকিৎসা দেওয়ার অথরিটি নই। এটা এমদাদের বক্তব্য।’

এমদাদ অভিযোগ করেন, ‘ঢাকায় করা মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা। রাজু আমার নাম ভাঙিয়ে মামলা করে মামলাবাণিজ্যে জড়িত।’ তবে রাজুর দাবি, ‘আমি মামলা বাণিজ্য করিনি। ছয় মাস ধরে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছি।’ রাজু উল্টো প্রশ্ন তোলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে এমদাদ কেন আমাকে জানাননি আন্দোলনকালীন সময়ে ৪ আগস্ট তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন?’

জুলাইযোদ্ধার নামে রাজুর ‘মামলা খেলা’র নালিশ

এমএ হাশেম রাজু দাবি করছেন, এমদাদ তাকে ঢাকায় মামলা করার অনুমতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমদাদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পেয়েছি। আমরা একসাথে ছয় মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করে মামলা করেছি। আন্দোলনের সময়ও আমি তার পাশে ছিলাম।’

কিন্তু এমন দাবি পুরোপুরি ভুয়া উল্লেখ করে এমদাদ বলেন, ‘রাজু ভাই আমার চোখ হারানোর পর আসে। পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে আলাপ হয়। বলেন, সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ এনে দেবেন। বললেন, কিছু কাগজে সই দিতে হবে। তখন তো ভাবিইনি, এই সাদা স্ট্যাম্পে সই দিয়ে কী বিপদ ডেকে আনছি।’

এদিকে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা দলিল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র কোনও সত্যায়িত কপি, নোটারি পাবলিকের শর্ত বা আইনগত প্রক্রিয়া মানা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাফিউল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কারও অজান্তে বা ভুল বুঝিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে তাতে ভিত্তিহীন বা মিথ্যা মামলা দায়ের করা গুরুতর অপরাধ। এখানে ভিকটিমের সম্মতি প্রমাণিত না হলে, ‘প্রতারণা’, ‘জালিয়াতি’, এমনকি ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও বিষয়টি আসতে পারে।’

এমদাদ বলেন, ‘হঠাৎ করে আমি যখন জানতে পারি রাজু আমার নাম ব্যবহার করে ঢাকায় মামলা করেছেন, তখন ভীষণ ভয় পাই। কারণ আমার বক্তব্যকে বিকৃত করে এমন কিছু হলে আমি তো আইনি জটিলতায় পড়বো।’

এ প্রসঙ্গে হাশেম রাজু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মামলা করেছি, কারণ এমদাদ নিজে করতে পারছিল না। ও আমাকে বলেছে, ‘ভাই আপনার মাধ্যমে যদি সরকার কিছু করে, তাহলে ভাল হয়।’ আমি তো কিছুই রাখি নাই। ওর হয়ে কাজ করেছি।’

তবে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া প্রসঙ্গে হাশেম রাজু নিরুত্তর থাকেন। কৌশলে এমদাদের স্বাক্ষর নিয়ে নিজে বাদি সেজে মামলাবাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজু বলেন, ‘মামলা বাণিজ্য করলে তো আসামিদের কারও কাছ থেকে কোনো কিছুর বিনিময়ে নাম বাদ দেওয়ার কথা। এরকম তো কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি।’

পুলিশের তদন্ত বলছে ভিন্ন কথা

ঢাকার শাহবাগ থানার ওসি খালেদ মনসুর বলেন, ‘আমাদের কাছে কেবল আদালতের নির্দেশ ছিল মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহ করার। এমদাদের কোনো উপস্থিতি বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আমাদের কাছে নেই। আমরা মামলা রেকর্ডও করিনি।’

জুলাই বিপ্লবকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা?

এদিকে ভুক্তভোগী জুলাইযোদ্ধা নিজে বাদি হয়ে চট্টগ্রামে মামলা করার পর থেকেই শুরু হয় অপপ্রচার। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন কিছু গণমাধ্যমে এমদাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন সব অপতৎপরতার মুখে বিস্মিত এমদাদ অভিযোগ করেন, এটি শুধু তাকে নয়, পুরো জুলাই আন্দোলনকেই কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা।

এমদাদ অভিযোগ করেন, তার মামলাটি করার পর থেকে বিভিন্ন দিক থেকে তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার মামলার আসামির তালিকায় থাকা শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারদের মালিকানাধীন কয়েকটি গণমাধ্যমে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এসব গণমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দাবি করা হয়, জুলাইযোদ্ধা এমদাদ একইদিন দুই শহরে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দেখিয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছেন।

এমদাদ বলেন, ‘ঢাকার মামলা ও গণমাধ্যমে আমার নামে প্রকাশিত বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলকভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা। আমার আত্মত্যাগ এবং আন্দোলনে ভূমিকা হেয় করার জন্যই রাজু এই মামলার নাটক সাজিয়েছেন।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আহমেদ রাশেদ বলেন, ‘এটা শুধুমাত্র এক ব্যক্তির লড়াই নয়। এর মাধ্যমে পুরো আন্দোলনের বৈধতা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।’

লড়াই শুধু আইনি নয়, নৈতিকতারও

এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে জীবনভর বয়ে চলা ক্ষত নিয়েও এমদাদ মাথা নিচু করেননি। কিন্তু আজ তার চোখের ক্ষত নয়, অন্তরের ক্ষতটাই বড় হয়ে উঠেছে।কারণ তার আত্মত্যাগকে ব্যবহার করে অন্য কেউ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণার নাটক।

প্রতারণার নানা অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৮ জুন এমদাদ এমএ হাশেম রাজুকে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান, যেখানে তিনি মামলাটি প্রত্যাহার এবং নিজের স্বাক্ষরিত কাগজপত্র ফেরতের আহ্বান জানান। তবে এখন পর্যন্ত কোনো জবাব পাননি।

এমদাদ জানান, তিনি এখন রাজুর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তার ভাষায়, ‘এই অপকর্মের বিরুদ্ধে শুধু আইনি লড়াই নয়, মানুষের আদালতেও তার বিচার হবে। জুলাই বিপ্লবের আত্মত্যাগকে যারা পুঁজি করে ফায়দা লুটতে চায়, তাদের মুখোশ একে একে খুলে যাবে।’

আন্দোলনের সাহসী মুখ সাইফুদ্দিন এমদাদ

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার কাচিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সাহসী মুখ। গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধা হিসেবে সরকারিভাবে প্রকাশিত তালিকায় তার নাম রয়েছে ২০২ নম্বর ক্রমে। জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকার রাজু ভাস্কর্য, আজিমপুর, বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের টার্গেটে পরিণত হন তিনি। সে সময় ছাত্র-জনতার ওপর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা একদল পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে একাই তর্কে জড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রামের এই তরুণের বীরত্বের সেই দৃশ্যটি মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় নেট দুনিয়ায়। এতে সে সময় গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে পড়েন এমদাদ।

১৫ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্য, ভিসি চত্বর, আজিমপুর, বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট ও বক্সিবাজার মোড়ে ধারাবাহিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে কয়েক দফায় আহত হন এমদাদ। এরপর গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে ২৮ জুলাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন। ১ আগস্ট কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এ অংশ নেন এবং ৩ আগস্ট আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও গণহত্যার বিচারের দাবিতে মিছিলে যোগ দেন। ৪ আগস্ট নিউমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভ চলাকালে বুকে ও পায়ে ছররা গুলিতে আহত হন এমদাদসহ বহু আন্দোলনকারী।

পরদিন ৫ আগস্ট কারফিউ উপেক্ষা করে বাদুরতলা থেকে মিছিল বের করলে সেটি বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, জিইসি হয়ে ওয়াসা মোড়ে পৌঁছালে পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। তখন চোখ, মুখ ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারান এমদাদ। তাকে প্রথমে শেভরণ আই হাসপাতাল, পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। ১১ আগস্ট ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তার মাথা ও ডান চোখ থেকে গুলি অপসারণ করা হয়। কিন্তু ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারান তিনি। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়, যেখানে এখনও তার চিকিৎসা চলছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm