চট্টগ্রামে রেলের গুদামে ‘গোপন ভান্ডার’, হিসাব মেলাতেই ধরা পড়ল বড় কেলেঙ্কারি
৭ ডিপোতে ৪ কোটি টাকার ২৪ হাজার সরঞ্জাম উদ্ধার
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে হঠাৎ এক অভিযানে বেরিয়ে এসেছে প্রায় চার কোটি টাকার মালামালের হদিস। দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে রাখা এসব মালামাল ডিপোতে জমিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছিল একদল অসাধু কর্মচারী। পরে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে দরপত্র আহ্বান করে সরকারি মাল বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। কিন্তু এক চালানের লাইট সরবরাহ তদারকির সময় ধরা পড়ে গোটা কারসাজি। এই ঘটনায় অভিযানে অংশ নেওয়া দুই কর্মকর্তা এখন রোষানলে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
সরঞ্জাম রাখার ১০টি ডিপোর মধ্যে ৭টিতে অভিযান চালিয়ে এসব মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। মালামালের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে, কৌশলে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব বেচে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল অসাধু চক্র। রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘শূন্যক্রয়ে’ মালামাল ব্যবহারের অপেক্ষায় ছিল তারা।
মালামাল জব্দের পর অসাধু কর্মচারীদের রোষানলে পড়া দুই কর্মকর্তার মধ্যে একজন বদলির জন্য আবেদনও করেছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি রোষানলে পড়ার কথা স্বীকার করেননি।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের অধীনে ২৫ ওয়াটের ১২৮৪ পিস এলইডি লাইট সরবরাহের দরপত্র পায় ‘মেসার্স এন জে ট্রেডার্স’। লাইট প্রতিটি মূল্য ছিল ৭৫৪ টাকা। ৯ লাখ ৭০ হাজার ৭০৪ টাকায় এই কার্যাদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা তাফসীর নামে ওই ব্যক্তি এ কাজে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘সামারা এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী পারভেজের সহযোগিতা চান। পারভেজ তাকে এসব লাইট সরবরাহ করার বিষয়ে আশ্বাস দেন।
কথা অনুযায়ী, ১২ জুলাই লাইট বুঝিয়ে দেওয়া কথা জানান পারভেজ। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তিনি লাইট পৌঁছাননি। পরে জানান, লাইট অলরেডি ডিপোতে জমা হয়ে গেছে। এ সময় নিশ্চিত হকে তাফসীর ফোন দেন ডিপো ‘এইচ’ এর ইনচার্জ নাছির উদ্দিনকে। তিনি লাইট বুঝে পেয়েছেন বলে জানান।
পরদিন নিজের চোখে লাইট দেখতে যান তাফসীর। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন—৮০০টি লাইট নতুন, অপর ৪৮৪টি পুরাতন। এছাড়া নতুন লাইটগুলোর ম্যানুফেকচারিং ব্যাচের সঙ্গে পুরাতনগুলো তারিখে ফারাক আছে। এরপর তিনি এ বিষয়টি জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে জানান।
এ ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের গিয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের (ইন্সপেকশন) সহকারী পরিদর্শক রফিক উল্লাহ সরঞ্জাম শাখা ডিপোর ‘এইচ’ ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন। তিনি দেখেন, সরবরাহ করা ৮০০ লাইটের ইনডেন্ট নম্বর ROP NDP1,2024/395 , ইনভেন্টর তারিখ- ৬/১০/২০২৪। এসব লাইটের সিরিয়াল, ব্যাচ একই। কিন্তু ৪৮৪ লাইট পুরাতন। পুরাতন এসব লাইটের মূল্য সাড়ে ৩ লাখের বেশি।
এরপর জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর (সরঞ্জাম শাখা) পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলামসহ ১০টি ডিপোর সাতটিতে অভিযান চালান। অভিযান এমন জোচ্চুরি উঠে আসে। অভিযানে পাওয়া মালামালগুলোর মধ্যে এনার্জি লাইট, হ্যালোজি, এলইডি, টিউব লাইটসহ বিভিন্ন আইটেমের প্রায় ২৪ হাজার লাউট আছে৷ আরও আছে ট্রেনের দরজার মেইন ডোর লক, হিংস ডোর লক, এসি কোচের জানালার চায়না গ্লাস, আমদানি করা ফিল্টার ডায়েসসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সামারা এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী পারভেজ এলইডি লাইট ব্যবস্থা করে দেওয়া কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, আগে ট্রান্সকম ইলেক্ট্রনিক্সের কর্মচারী ছিলেন তিনি। সে সুবাদে তাফসীরের অনুরোধে এসব লাইট সরবরাহ করেছেন তিনি।
কত পিস লাইট সরবরাহ করেছেন এবং সরবরাহ দেওয়ার সময় তাফসীরকে জানাননি কেন, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আগেও আমি ১৮০০ পিস লাইট সরবরাহ করেছি।
জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর (সরঞ্জাম শাখা) পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, ৭ ডিপোতে অভিযান পরিচালনার করা হয়েছে। এসব মালামালের মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা হতে পারে।
তবে এ ঘটনার পর বদলির আবেদন কেন করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে চাকরির ৩ বছর হয়েছে। তাই স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন করেছি।
ডিজে