সাদ মুসা গ্রুপের নীলনকশায় সাত অসহায় ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ, সিডিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ

অবৈধভাবে ৮ তলার ভবন বাড়িয়ে করা হয় ৯ তলা

চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালীর সাব-এরিয়ায় পার্কিং ফ্লোরের অজুহাতে সাত ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদের পর আবারও ভাড়া দিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ। এ কাজে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কিছু অসৎ কর্মকর্তাও জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

সাদ মুসা গ্রুপের নীলনকশায় সাত অসহায় ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ, সিডিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ 1

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দেওয়ানবাজার সাব-এরিয়ার খলিফাপট্টির প্রবেশমুখে ডানপাশের ভবনটির প্রথম তলার ওই জায়গায় বড় পরিসরে দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। জায়গা ভাড়া নিয়েছে ‘খামারি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। দোকান মালিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, দোকানগুলো পুনরায় ভাড়া দিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসীন। সেই সঙ্গে ওই ভবনে রয়েছে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও।

জানা গেছে, ২০০১ সালে ‘রোকেয়া হেরিটেজ’ নামে ওই ৮ম তলা ভবনের প্রথম তলা বরাদ্দের জন্য অর্থ জমা দেন ব্যবসায়ী প্রণব চৌধুরী, লিটন কান্তি সেন, অনুরূপ পাল, অ্যাপোলো চৌধুরী, রীমা পাল (পক্ষে ডা. সমীর কুমার পাল), মনছুর আলী এবং মিতা মজুমদার। এর মধ্যে অনুরূপ পাল ৩ লাখ টাকা এবং অন্যরা আড়াই লাখ টাকা করে জমা দেন। ওই সময়ে ভবনটির মালিকানায় ছিলেন এসএম মঈনুল হক, এসএম সাঈদুল হক ও এসএম এহতেশামুল হক।

২০০৮ সালে সাত কোটি টাকার ওই ভবনটি মাত্র এক কোটি টাকায় কিনে নেয় সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসীন। এরপর থেকেই ভাড়া নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ওই সাত ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করার নীল নকশা তৈরি করে ‘সাদ মুসা গ্রুপ’।

সাদ মুসা গ্রুপের সেই নীল নকশার পূর্ণ রুপ দেয় সিডিএ’র সেই সময়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ওই ভবনের নিচ তলায় (গ্রাউন্ড ফ্লোর) ছিল পার্কিং। ভবনের পাশের সড়ক উঁচু করার পর নিচ তলা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ভবনের অনুমোদন না নিয়েই এক তলা বাড়িয়ে নবম তলা করে ফেলে সাদ গ্রুপ। এরপরই প্রথম তলাকে নিচ তলা দেখিয়ে সিডিএ সেই সময়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয় ওই সাত ব্যবসায়ীকে।

এর আগে ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম তলায় অবস্থিত দোকান না ভাঙার জন্য এবং দোকানঘর রক্ষা করার জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছিলেন ওই ব্যবসায়ীরা। এরপরও সিডিএর কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর বিনা নোটিশে ওই সাত ব্যবসায়ীর দোকান উচ্ছেদ করায় সাদ মুসা গ্রুপ।

কিন্তু পার্কিংয়ের অজুহাতে উচ্ছেদ করা হলেও সেই জায়গাটি আবারও ভাড়া দিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ।

ভবনের নতুন ভাড়াটিয়া ‘খামারি’র মালিক মানিক সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘৬/৭ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। কার থেকে ভাড়া নিয়েছি, কে ভাড়া দিয়েছে, এগুলো আপনাকে বলতে যাব কেন, ভুয়া সাংবাদিক কোথাকার। বক্তব্য নেওয়া ইচ্ছা হলে লিখিত অনুমতি নিয়ে আসেন, তারপর বক্তব্য দিব।’ এরপর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সাত ব্যবসায়ীর একজন ‘মনসা জেনারেল স্টোর’র স্বত্বাধিকারী অনুরূপ পাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের উচ্ছেদ করার পর পুনরায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে ওই জায়গা। ভবনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে পার্কিং স্পেসে এখনও দুটি দোকান চালু করা হয়েছে। ভবনে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রথম তলায় দোকান ছিল সাতটি, ওটা পার্কিং স্পেস ছিল না। সাদ মুসা গ্রুপের সঙ্গে দুইবার বৈঠক হয়েছে আমাদের। ঘর ভাড়া মামলা তুলে নিতে বলেছিল তারা।’

তিনি বলেন, ‘আগে জমা দেওয়া সেলামি অগ্রিম হিসেবে থাকার কথা। তিন হাজার টাকা করে ভাড়া চেয়েছিল তারা। বনি-বনা না হওয়ায় সিডিএ’র সহযোগিতায় আমাদের উচ্ছেদ করে দেয়। আমাদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়, যার জন্য কোনো মালমাল আমরা সরাতে পারিনি। আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। আর্থিক অবস্থা অবনতি জন্য মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি।’

অনুরূপ পাল বলেন, ‘ভবনের অনুমোদন আট তলার ছিল। এক তলা বাড়িয়ে নয় তলা করেছে, ফার্স্ট ফ্লোর পার্কিং দেখানোর জন্য। সিডিএ’র সাথে যোগসাজশ করে আবাসিকে বাণিজ্যিক ব্যবহার দেখিয়ে আমাদের দোকান ভাঙে সাদ মুসা গ্রুপ। টাকার অভাবে মামলাও চালাতে পারছি না। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। অসুস্থ মা দোকান দোকান করে মারা গেছেন। বাচ্চাদের পড়ালেখা চালাতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘দোকানটা ফেরত পেলে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে পারব, সেই আশায় বর্তমান সিএমপি কমিশনার, সিটি মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছি আমরা, যাতে ন্যায় বিচার পাই। এজন্য প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ব্যবসার শেষ সম্বল আমাদের পরিবার ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। দোকানগুলো ফেরত না পেলে আমাদের এ সাত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দোকানগুলোর যাতে ফেরত পাই, সেজন্য প্রধান উপদেষ্টা কাছের অনুরোধ করছি।’

ভবনটি আগের মালিকদের একজন এসএম সাঈদুল হক জানান, ‘ভবন বিক্রি বাবদ টাকা সাদ মুসা গ্রুপ থেকে নিলেও সাত দোকান মালিকদের দোকান সালামি বাবদ ১৭ লাখ টাকা আমরা নেয়নি। সেই হিসেবে দোকানদারের ক্ষতিপূরণ সাদ মুসা গ্রুপের দেওয়া উচিত।’

এদিকে চেক প্রত্যাখ্যান (ডিজঅনার) মামলায় সাদ-মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন বর্তমানে কারাগারে। ফলে এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সাদ মুসা গ্রুপ পরিচালিত মুঠোফোনে নম্বরটিতে কল করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি।

পার্কিংয়ের স্থলে দোকান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে সিডিএ’ পরিদর্শক মো. তোফায়েল হোসেনের মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। সরাসরি বক্তব্য নিতে গেলেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান নুরুল কবির বলেন, ‘আমি এখন ঢাকা আছি। আপনি অফিসে গিয়ে আপনার অভিযোগটি সিডিএ’র অথরাইজড কর্মকর্তা কাজী কাদের নেওয়াজ দিয়ে আসুন।’ এরপর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm