পালানোর ১১ মাস পর স্ত্রীসহ হাছান মাহমুদের দেশত্যাগে এলো ‘নিষেধাজ্ঞা’

পতনের আগের রাতে দুবাই পালায় পরিবার

দেশ ছেড়ে পালানোর ১১ মাস পর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার ‘দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা’ দিয়েছেন আদালত।

গত ২০ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিয়েতে দেখা গেছে হাছান মাহমুদকে।
গত ২০ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিয়েতে দেখা গেছে হাছান মাহমুদকে।

সোমবার (২৩ জুন) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব।

লন্ডনের গ্যাংসহিলে ঈদের নামাজ শেষে হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার ছেলে সাফওয়ান ও ভাতিজা।
লন্ডনের গ্যাংসহিলে ঈদের নামাজ শেষে হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার ছেলে সাফওয়ান ও ভাতিজা।

চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনের সাবেক এমপি হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুটি আবেদন করেন দুদকের সহকারী পরিচালক আল-আমিন। পরে বিচারক ওই আবেদন মঞ্জুর করেন।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে জার্মান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের এক সভায় প্রথম হাছান মাহমুদকে প্রকাশ্যে দেখা যায়।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে জার্মান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের এক সভায় প্রথম হাছান মাহমুদকে প্রকাশ্যে দেখা যায়।

দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে হাছান মাহমুদ বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের ৭৭টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত।

‘বিদেশ গমন ঠেকানো দরকার’

হাছান মাহমুদের বিষয়ে দুদকের আবেদনে বলা হয়, মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অবৈধভাবে এক কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩১৮ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন হাছান মাহমুদ। তার নিজ, যৌথ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এই অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ৬ এপ্রিল দুদক মামলা করে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

অন্যদিকে নূরান ফাতেমার বিষয়ে দুদকের আবেদনে বলা হয়, স্বামী হাছান মাহমুদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে নূরান ফাতেমা ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন। তার নিজ, যৌথ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ৫৬টি ব্যাংক হিসাবে ৬৮৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। গত ৬ এপ্রিল দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমন ঠেকানো দরকার।

পালিয়েছেন ১১ মাস আগেই

গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার ২৫ দিন পর নিরাপদে দেশ ছাড়েন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তবে অবস্থা আঁচ করতে পেরে তার আগেই দেশ ছেড়ে দুবাইয়ে পালিয়ে যান তার স্ত্রী নূরান ফাতেমাসহ সন্তানরা। এদিকে প্রায় ১১ মাস পর হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার ‘দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা’ দিয়েছেন আদালত।

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র সংবাদমাধ্যমকে জানায়। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ডুসেলডর্ফের একটি রেস্টুরেন্টে যান খাবার খেতে। সেখান থেকে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।

হাছান মাহমুদ সেই থেকে বেলজিয়ামের লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন। বেলজিয়ামজুড়ে তার আরও অন্তত চারটি বাড়ি আছে। তবে তিনি প্রায়ই যাওয়া-আসা করছেন লন্ডনেও। সেখানে তার ছেলে সাফওয়ান মাহমুদ পড়াশোনা করেন।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে আওয়ামী লীগের সভায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েন হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানস্থলে তিনি উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তিনি নীরবে সভাস্থল ছেড়ে যান।

পলাতক নেতার বিদেশি সফরনামা

চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউনিভার্সিটি লিবর ডি ব্রাসেলসের (ইউএলবি) বাইরের একটি উঠানে শহীদ মিনারের একটি কাঠামো সঙ্গে করে নিয়ে এসে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের পলাতক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের চার নেতা ও তাদের স্ত্রীরা। একুশের শোকাবহ দিনে উপস্থিত মোট সাত অংশগ্রহণকারীকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেলেও হাছান মাহমুদ ছিলেন বিধ্বস্ত চেহারায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে এক ভিডিওতে তার গলার স্বরও ছিল অনুচ্চ।

এরপর গত ৩০ মার্চ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে দেখা গেছে লন্ডনের গ্যাংসহিল এলাকার আল-কালাম মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে। ঈদের নামাজ শেষে পরিচিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন হাছান মাহমুদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন লন্ডনে পড়াশোনা করা তার ছেলে সাফওয়ান মাহমুদ। ছেলের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে লন্ডনে যান তিনি।

সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলে ডা. সৈয়দ ফাইয়াজ রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা গেছে হাছান মাহমুদকে।

৪ আগস্ট রাতেই পরিবারের উড়াল

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাতে হাছান মাহমুদের স্ত্রী নূরান ফাতেমাসহ পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ থেকে পালিয়ে যান। ওই ফ্লাইটে তার স্ত্রী নূরান ফাতেমা ছাড়াও তাদের সন্তানরা ছিলেন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নেই থাকেন বলে জানা গেছে।

ভাগ্য খুলেছিল ২০০১ সালে

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ভাগ্য খুলে যায় হাছান মাহমুদের। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। অন্তত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm