চট্টগ্রামে হার্টের রিংয়ে লুকানো কোটি টাকার সিন্ডিকেট, ওটিতে শুরু হয় বাণিজ্য
৫০ হাজারের রিং দেড় লাখে: এক রিংয়ে তিন গুণ বিল
চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে হার্টের রোগীদের জীবন রক্ষাকারী স্টেন্টকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। জীবন রক্ষার নামে সেখানে চলছে গোপন কমিশনের খেলা। প্রাণ বাঁচানোর যন্ত্র আজ পরিণত হয়েছে কমিশনভিত্তিক বাজারি পণ্যে। রোগীদের চাপের মুখে ঠেলে দিয়ে চড়া দামে স্টেন্ট বিক্রি করে কোটি টাকার বাজার গড়ে তুলেছে একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অন্তত ২৭টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ৫০ জনেরও বেশি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল।
রোগীরা বলছেন, অপারেশন থিয়েটারে ‘জিম্মি’ করে এমনভাবে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যাতে কেউ রিংয়ের দাম কিংবা গুণগত মান নিয়ে কথা বলার সাহস পান না। একজন রোগীকে কখন, কোন দেশের রিং বসানো হলো—সেটি জানতে পারেন না নিজেও। অথচ ভারতসহ অন্যান্য দেশে একই মানের স্টেন্টের দাম এক-তৃতীয়াংশ, কিন্তু চট্টগ্রামে একই পণ্যে গুণে গুণে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামে হাতিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
হার্ট স্টেন্ট হচ্ছে একটি ছোট জালের মতো নল যা সরু বা অবরুদ্ধ করোনারি ধমনীতে ঢোকানো হয়। স্টেন্ট এই ধমনীগুলোকে খোলা রাখতে সাহায্য করে এবং হৃদপিন্ডের পেশীতে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করে।
দাম কমলেও থামেনি লুটপাট
২০২৪ সালের ২ এপ্রিল সরকার ২৩ ধরনের স্টেন্টের দাম ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর নির্দেশ দেয়। ইউরোপীয়, কোরিয়ান, জাপানি, ভারতীয় স্টেন্টসহ অন্তত ১২টি দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দাম কমিয়ে আনা হয়। ভারতের বায়োমাইম ব্র্যান্ডের একটি স্টেন্ট ৯৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকায় নামানো হয়। অথচ চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে সেই দামের প্রতিফলন কোথাও নেই।
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মানের স্টেন্টের নির্ধারিত দাম ১ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা হলেও ভারতের বাজারে একই মানের রিং বিক্রি হয় মাত্র ৫০ হাজার টাকায়। অথচ চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে কোনো নির্ধারিত দামে স্টেন্ট বসানোর নজির পাওয়া যায়নি।
কমিশনের কাঁটায় বিদ্ধ রোগী
রোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, চিকিৎসকরা প্রতিটি রিং বসানোর বিপরীতে পাচ্ছেন ১৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন। ফলে চিকিৎসক নিজের পছন্দের উচ্চমূল্যের স্টেন্ট রোগীকে বাধ্যতামূলকভাবে নিতে বলেন। অনেক সময় চিকিৎসকদের সঙ্গে আমদানিকারকের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় কমিশনের জন্য কমদামী অথচ উন্নত স্টেন্টগুলোর পরিবর্তে উচ্চমূল্যের বিকল্প ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামের একটি নামকরা হাসপাতালের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘আমরা কেবল ক্যাথল্যাব ও ওটির ভাড়া নেই। কোন রিং ব্যবহার হবে, কত দামে হবে এসব চিকিৎসক ও রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে ঠিক হয়।’
অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসকদের একটি অংশ এখন সরাসরি স্টেন্ট বাণিজ্যের অংশীদার হয়ে উঠেছেন। চট্টগ্রামের প্রবীণ এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কমিশনের লোভে চিকিৎসার নৈতিকতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই ভুল চিকিৎসা ও মৃত্যুর অভিযোগ আসছে। অথচ কেউ দায় নিচ্ছে না।’
অদৃশ্য সংকট বানিয়ে বাড়ানো হয় দাম
সরকারি দাম নির্ধারণের পর কিছু আমদানিকারক কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ রেখে বলা হচ্ছে ডলারের দাম বেড়েছে, কাস্টমস জটিলতা আছে। এর ফলে ন্যায্য মূল্যের স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আমেরিকান ব্র্যান্ডের দামি স্টেন্ট দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে, যার অজুহাত দেখিয়ে রোগীদের পকেট থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ডের রিং সরবরাহ বন্ধ থাকলেও আমেরিকান ব্র্যান্ডের সরবরাহ চালু রয়েছে। এতে রোগী সেবা একেবারে বন্ধ না হলেও, সেবার মান ও খরচ অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
রোগীর করুণ অভিজ্ঞতা, প্রশ্নের সুযোগ নেই
চট্টগ্রামের হার্টের রোগী কামাল আহমদ জানান, কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায় হার্টের রিং বসিয়েছেন তিনি। মোহাম্মদ শাহাজাহান নামের আরেক রোগী বলেন, তিনিও অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু কেউ জানেন না, কোন ব্র্যান্ডের স্টেন্ট বসানো হয়েছে।
রোগীদের স্বজনরা বলেন, ‘রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে কোনো প্রশ্ন তোলাও সম্ভব না। সোজা বলে দেয় এটা বসাতে হবে, এখনই বসাতে হবে। আপনার রোগী লাইনে আছে।’
এক স্টেন্টে একাধিক হাত, লুটপাট বহু গুণ
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ উন্নত স্টেন্টের মূল্য সরকার নির্ধারণ করেছে এক লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেটিই বিক্রি হচ্ছে ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে। অথচ সেই একই মানের স্টেন্ট ভারতে পাওয়া যাচ্ছে ৫০ হাজার টাকায়। কেন এই পার্থক্য? কারণ একটাই—কমিশন।
একাধিক সূত্রে খবর নিয়ে জানা গেছে, অন্তত ২৭টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও ৫০ জনেরও বেশি কার্ডিওলজিস্ট এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। একজন রোগীর স্টেন্ট বসানোর বিপরীতে চিকিৎসককে দেওয়া হয় ১৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন। এভাবেই একটি রিংয়ের দাম এক লাফে হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।
হার্টে আমেরিকান দখল: সরবরাহ কম, দাম চড়া
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ হাজার স্টেন্ট বসানো হয়। এর মধ্যে অর্ধেকই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এছাড়া জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, ভারত, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকেও স্টেন্ট আসে।
দেশে ২৭টি প্রতিষ্ঠান ৪৪টি ব্র্যান্ডের স্টেন্ট আমদানি করে। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি ব্র্যান্ড। বাকি ২৩ কোম্পানি জার্মানির ১০টি, আয়ারল্যান্ডের সাতটি, সুইজারল্যান্ডের ছয়টি, স্পেনের তিনটি, ভারতের তিনটি, নেদারল্যান্ডসের দুটি, পোল্যান্ডের দুটি, ইতালির দুটি, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের একটি করে ব্র্যান্ডের স্টেন্ট বাংলাদেশে আমদানি করে।
বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ডের করোনারি স্টেন্ট আমদানি করে—এমন কোম্পানিগুলো সরবরাহ বন্ধ রাখলেও আমেরিকান ব্র্যান্ডের সরবরাহ চালু রয়েছে। এতে রিং পরানো বা স্টেন্ট বসানোর কাজ একেবারে বন্ধ হয়নি। চাহিদা মেটানো হচ্ছে আমেরিকান ব্র্যান্ডের স্টেন্ট দিয়ে। এ জন্য দাম বেশি বলে দাবি।
যেখানে স্টেন্ট বসানো হয় বেশি
চট্টগ্রামে বেশি স্টেন্ট বসানো হয়, এমন হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে—চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নগরীর জিইসি মোড় এলাকার মেডিকেল সেন্টার হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল লিমিটেড, প্রবর্তক মোড়ের সেন্টার ফর স্পেশালাইজড কেয়ার এন্ড রিসার্চ (সিএসসিআর) হাসপাতাল, মেহেদীবাগ এলাকার ন্যাশনাল হাসপাতাল চট্টগ্রাম এন্ড সিগমা ল্যাব লিমিটেড, ম্যাক্স হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক, পাঁচলাইশ কাতালগঞ্জ সড়কের পার্কভিউ হসপিটাল লিমিটেড, পাহাড়তলীর ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেড, অক্সিজেন আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল ও আগ্রাবাদ এলাকার মা ও শিশু হাসপাতালে
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বছরে প্রায় ছয় হাজার স্টেন্ট বসানোর তথ্য মিললেও চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে বছরে কী পরিমাণ রোগীকে রিং বসানো হয়, তার সঠিক তথ্য কোথাও নেই।
শৃঙ্খলা নেই মেডিক্যাল ডিভাইসে
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, ‘সাত বছর আগে মেডিক্যাল ডিভাইস বিক্রির কোনো গাইডলাইন ছিল না। পরে সরকার মার্কআপ ফর্মুলা (১.৪২%) নির্ধারণ করে এবং প্রথম ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ব্র্যান্ডের রিংয়ের দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বাকি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে সেই ফর্মুলা আজও মানা হয়নি।’
দায় চাপানোর খেলা
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এসএম সুলতানুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা সব হাসপাতালে হার্ট রিং সম্পর্কিত নির্দেশনা পাঠিয়েছি, যাতে রোগীদের পেমেন্ট ভাউচারে রিংয়ের নাম ও দাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। তবে অনেক হাসপাতাল অপারেশন থিয়েটার, ক্যাথল্যাব ভাড়া, সিট ভাড়া ও ডাক্তারদের চার্জসহ অতিরিক্ত বিল নিচ্ছে। এজন্য রোগীরা উচ্চমূল্যে রিং বসানোর অভিযোগ করছে। আমরা সরাসরি এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কারণ হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স সিভিল সার্জন কার্যালয় দেয়। তাদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করা প্রয়োজন, আমরা সমাধানে কাজ করব।’
ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘এই বিষয়ে বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। শহরের সব হাসপাতালের সভাপতি বিভাগীয় পরিচালক এবং মেম্বার সেক্রেটারি সিভিল সার্জন। আপনাদের তাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত।’
নতুন যোগ দেওয়া চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আপনারা যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারি।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. অং সুই প্রূ মারমা বলেন, ‘একটি রিংয়ের জন্য তিনটির সমান বিল নেওয়া দুঃখজনক। আমি বিষয়টি তদন্ত করবো।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ও বিশিষ্ট আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘এই ভয়াবহ দুর্নীতি বন্ধে ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমদানিকারক, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে অশুভ সমঝোতা ভাঙতে হবে। না হলে চিকিৎসা সেবার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
সিপি