সুফি মিজান পরিবারকে কাঠগড়ায় তুলছে খুলশীর মামলা, ‘মা জননী’ ১ নাম্বারে
ছাত্র আন্দোলন দমনে অর্থায়নের বড় অভিযোগ
চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন, হত্যাচেষ্টা ও অর্থায়নের অভিযোগে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান ‘সুফি’ মিজানুর রহমান ও তার তিন ছেলেসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ১৬৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ছাড়াও প্রভাবশালী লোকজন। মামলা দায়েরের পরপরই মামলাটিকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে চকবাজার থানা পুলিশ মামলার অন্যতম আসামি বাশঁখালী উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী ইয়ামুন নাহারকে গ্রেপ্তার করেছে।

চোখ হারানো গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মামলা
গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের খুলশী থানাধীন ওয়াসা মোড়ে ছাত্র-জনতার উপর সংঘটিত সশস্ত্র হামলার ঘটনায় এই মামলা দায়ের করেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারানো ছাত্র আন্দোলনকারী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। দীর্ঘ চিকিৎসাজনিত ভোগান্তি শেষে গত ১৭ জুন খুলশী থানা এই মামলাটি গ্রহণ করে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, চট্টগ্রামের এই মামলাটি ছাত্র আন্দোলন সংক্রান্ত বিচারপ্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা আন্দোলনের প্রকৃত ঘটনাগুলো তুলে ধরার এবং ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আন্দোলন দমনে অর্থায়ন ও হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ
মামলায় আসামি তালিকায় পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান ‘সুফি’ মিজানুর রহমান ছাড়াও রয়েছেন তার তিন ছেলে— পিএইচপি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরী, পরিচালক আমির হোসেন সোহেল ও আখতার পারভেজ চৌধুরী। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে টাকা ছিটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই মামলার বাদী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়াও ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ সঙ্গে সুফি মিজান ও তার ছেলেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এমনকি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষদিকে আয়োজিত ব্যবসায়ী সম্মেলনগুলোতেও তার সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখেছি আমরা। তিনি ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্যতম আর্থিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।’

১৬৭ জনকে আসামি করে দায়েরকৃত এই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১০৮, ১১৪, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৫০৬ ও ৩৪ ধারার অভিযোগ, যার মধ্যে রয়েছে হত্যাচেষ্টা, গুরুতর আঘাত, অঙ্গহানি, পরিকল্পিত হামলা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো গুরুতর অপরাধ।
বিশেষ দিক হলো, চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এটিই প্রথম মামলা যেখানে কোনো অজ্ঞাত আসামি নেই। এর মাধ্যমে আগের মামলা বাণিজ্য ও নিরীহ মানুষকে হয়রানির প্রবণতা থেকে সরে আসা হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হামলায় নেতৃত্ব, পৃষ্ঠপোষকতা ও সহিংসতার অভিযোগ
মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে হামলার পরিকল্পনাকারী, সরাসরি অংশগ্রহণকারী ছাড়াও আন্দোলন বানচাল ও গণহত্যায় অর্থায়নকারীদের নামও রয়েছে। এজাহারে এমদাদ উল্লেখ করেছেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় ১৪–২০ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর একের পর এক হামলা চালানো হয় এবং শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের মিছিলে গুলি করে আন্দোলন দমন করা হয়।
মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চট্টগ্রামের দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার নুরুচ্ছাফা তালুকদারের পুত্র হাছান মাহমুদ, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বনফুল কোম্পানির মালিক এমএ মোতালেব এবং আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী, ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য এডভোকেট কামরুল ইসলাম, রাউজান আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য ও সমকাল পত্রিকার প্রকাশক এ কে আজাদ, ঢাকার গুলশান এলাকার বাসিন্দা ও বাংলা টিভির এমডি সৈয়দ সামাদুল হক।
গুলিতে চোখ হারানো শিক্ষার্থীর যন্ত্রণার বিবরণ
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘গুরুতর আহত জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃত এমদাদ মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সময় ঢাকার রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় একাধিকবার হামলার শিকার হন তিনি। এক পর্যায়ে গত ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের বাদুরতলা থেকে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে খুলশীর ওয়াসা মোড়ে তিনি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন।
এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, সেদিন পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা সরাসরি তার উপর গুলি চালায়। ছররা গুলি তার মাথা, মুখ, ডান পা ও চোখে লাগে। এতে তিনি ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারান। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেভরণ আই হসপিটাল, ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং পরে সিএমএইচ-এ দীর্ঘ চিকিৎসা নিলেও তার দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে আসেনি। বর্তমানে তার শরীরেও এখনও গুলির ক্ষত রয়ে গেছে এবং চিকিৎসা অব্যাহত আছে।
সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ তার এজাহারে উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে থেকে, গোপনে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এবং শারীরিক-মানসিক দুর্বলতার মধ্যেও তিনি এই মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, “আমি নিজে এবং অন্যান্য সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে, পত্র-পত্রিকা পড়ে ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে ও বুঝতে পারি যে, দেশের উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তাতে দুই হাজারের বেশি নিরীহ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং বিশ হাজারের মতো মানুষ কোনো না কোনোভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।”
তিনি এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরাচারী সরকার জনগণের ওপর এ ধরনের দমনপীড়ন চালাতে না পারে।
আসামির তালিকায় আরও
কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের মধ্যে আসামির তালিকায় রয়েছেন— সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল্লাহ আনসারী, ছাত্রলীগ নেতা বাঁশখালী চাঁনপুরের মো. মুজাহিদুল আলম, পটিয়া চক্রশালার ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা মো. এমরান, পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা হাছি মিয়া ও ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চন্দনপুরা মনুমিয়াজি লেনের মো. জারিফ (২০), বঙ্গবন্ধু পরিষদ বাঁশখালী উপজেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি আবছার উদ্দিন চৌধুরী জান্টু, বকশিরহাট ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ছোটন প্রকাশ চাকু ছোটন, চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়ন সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাকলিয়া থানা শ্রমিক লীগের নেতা শফিউল হকের পুত্র নাজমুল হক, বক্সির হাট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা বাকলিয়া ফাইভ স্টার গলির মোহাম্মদ শাজাহান রাজু, হালিশহর ২৫ নং রামপুরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী আলকারাছ মুন্সী, আকবরশাহ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফিরোজশাহ কলোনির মুরাদ হোসেন বিপ্লব, বাশঁখালী উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেত্রী চন্দনপুরা মনুমিয়াজি বাড়ির ইয়ামুন নাহার, সাতকানিয়া থানা যুবলীগ নেতা দেবাশীষ দাশ নয়ন, দুর্গা সিং হাজারীর পুত্র আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা গৌতম সিং হাজারী।
‘মা জননী’ থেকে ‘রেডিয়েশন’: মিজানের বক্তব্য ঘিরে পুরনো বিতর্ক
‘সুফি’ মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তার পক্ষে আয়োজিত এক ‘ব্যবসায়ী সম্মেলনে’ পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান ‘সুফি’ মিজানুর রহমান শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘জীবনে আর কতোবার যে প্রধানমন্ত্রী হবেন আল্লাহই জানেন, আমরা জানি না। এইবার, তারপরের বার, আরও বহুত বার ইনশাল্লাহ।’
শেখ হাসিনাকে ‘মা জননী’ ডেকে ‘সুফি’ মিজান বলেন, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন সোনার বাংলা। আমার আমাদের মা আমাদের মা জননী আপনাকে নিয়ে আমরা ইনশাল্লাহ হীরার বাংলা তৈরি করবো।’
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া আরেক ভিডিওচিত্রে শোনা যায়, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান ‘সুফি’ মিজানুর রহমান ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘আমাদের মহান নেত্রী আল্লাহর নেয়ামত আমাদের জন্য। পৃথিবীতে ৫৬০টা মডেল মসজিদ কেউ দিতে পারে নাই, তিন লক্ষ গৃহহীন মানুষকে জমিনসহ তার ঠিকানা— এটা বাংলাদেশের মহীয়সী রমণী আমাদের দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু তনয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এটা পৃথিবীতে কেউ করতে পারে নাই।’
‘সুফি’ মিজান বলেন, ‘আপনি দেখবেন উনি যখন মিটিংয়ে থাকেন, সচল থাকেন, আনন্দে মুখরিত থাকেন, তখন তার থেকে মানুষের মধ্যে রেডিয়েশন হয়।’
এসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। বর্তমানে ওইসব বক্তব্যসহ বিভিন্ন উপকরণ মামলার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।