পুরনো ‘দাগী’ আকাশ চৌধুরী এখনও অধরা, জামায়াতের বহিষ্কার, দায় নিচ্ছে না শিবির
চট্টগ্রামে রক্তাক্ত ছাত্রসমাবেশ
চট্টগ্রামে নারীসহ একটি ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলায় জড়িত জামায়াত নেতা আকাশ চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত এই জামায়াত নেতাকে ধরতে পারেনি পুলিশ।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে ‘ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়ায়’ বেকসুর খালাস দেওয়ার প্রতিবাদে ২৮ মে চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট। সেই সমাবেশে ঘটে এক ভয়াবহ হামলা। ‘শাহবাগবিরোধী মঞ্চ’ নামধারী হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি গোষ্ঠীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মব’ গড়ে তোলার আহ্বানের মধ্যেই বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা পুলিশের উপস্থিতিতেই সমাবেশস্থলে হামলা চালায়।
হামলাকারীরা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। নারী কর্মীদের লক্ষ্য করে ব্যবহার করা হয় অশ্রাব্য ভাষা, দেওয়া হয় অকথ্য গালিগালাজ এবং শারীরিক লাঞ্ছনা। নেতা-কর্মীদের মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়। আহত হন অন্তত ১৫ জন, যাদের মধ্যে তিনজন গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিঁড়িতে দাঁড়ানো গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অ্যানি চৌধুরীসহ কয়েকজনকে সজোরে লাথি মারেন মাথায় ক্যাপ পরিহিত আকাশ চৌধুরী।
এদিকে ঘটনার দায় অস্বীকার করে শুক্রবার (৩০ মে) জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘সংঘটিত ঘটনার সাথে জামায়াতে ইসলামীর কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই এই ঘটনার কোন দায়-দায়িত্ব জামায়াতে ইসলামী বহন করবে না। সেদিনের অনভিপ্রেত ঘটনার দায় কেবলমাত্র সেখানে উপস্থিত দায়ী ব্যক্তিদের ওপরই বর্তায়। বিশেষ করে আকাশ চৌধুরী নামে সংগঠনের একজন কর্মী উর্ধ্বতন সংগঠনের অনুমতি ব্যতিরেকে উপস্থিত হয়ে উক্ত কর্মসূচিতে যে কাজ করেছে তা চরম নিন্দনীয়। সুতরাং কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ও উপর্যুক্ত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জড়িত আকাশ চৌধুরীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলো।’
দায় নিচ্ছে না ছাত্রশিবির
হামলার সঙ্গে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম উত্তর শাখার সাবেক প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক আবরার হোসাইন রিয়াদ, তৌকির, আসফারসহ আর আরও কয়েকজনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
বুধবারের সংঘর্ষের সময় শিবিরের কেউ ছিলেন না বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল ও সেক্রেটারি মুমিনুল হক। এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেন, শিবিরের কোনো কর্মী এ ধরনের কাজে জড়িত নন।
ওই বিবৃতিতে তারা দাবি করেন, ‘যে ব্যক্তি হামলার সঙ্গে জড়িত, তিনি ইতিপূর্বে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত নন। তার ব্যক্তিগত আচরণের দায়ভার ছাত্রশিবির নেবে না।’
আকাশ এখনও অধরা
এদিকে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত আকাশ চৌধুরীকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তার বর্তমান অবস্থান কোথায়, সেটা বলতে পারছেন না জামায়াতের নেতাকর্মীরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকাশের নেতৃত্বে এর আগেও নগরীর মুরাদপুরে সুন্নিদের জমায়েতে হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, রাতে প্রকাশ্যে নগরীর বহদ্দারহাট মোড় থেকে এক তরুণকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন আকাশ চৌধুরী। এ সময় আশেপাশের মানুষ এসে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে আকাশ নিজেকে ‘বহদ্দারহাট জামায়াতের সেক্রেটারি’ বলে পরিচয় দেয়। অপহরণের শিকার সেই তরুণের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে আর কিছু জানা যায়নি।
সাতকানিয়ার সিবগাতুল্লাই শহরে ‘আকাশ’
আকাশ চৌধুরীর প্রকৃত নাম সিবগাতুল্লাহ চৌধুরী আকাশ। দেড় বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে তার। তার বাবা সাতকানিয়া পৌরসভা ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নেচার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা। আকাশের মা খালেদা সাতকানিয়া পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর ছিলেন। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। সাতকানিয়া আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, আকাশের মায়ের চিকিৎসার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তহবিল থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে দেন তার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া।
আকাশের বাবা জামায়াত নেতা নেচার উদ্দিন আওয়ামী লীগ আমলে নিজেকে বিপ্লব বড়ুয়ার বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতেন। সাতকানিয়া আওয়ামী লীগে বিপ্লব বড়ুয়ার অনুসারী একাধিক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন, গণভবন কমপ্লেক্সে বিপ্লব বড়ুয়ার বাসায় জামায়াত নেতা নেছার চৌধুরীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। নেতাদের কেউ কেউ এ নিয়ে মৃদু আপত্তি জানালে বিপ্লব বড়ুয়া তাদের বলেন, ‘সে আমার বন্ধু এবং এ বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না।’ আওয়ামী লীগ আমলে নেছার চৌধুরী ও তার ছেলে আকাশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও বিপ্লব বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পুলিশও তাদের কখনও ঘাটায়নি।
কয়েক মাস আগেও চট্টগ্রাম নগরীর ৮ নম্বর শুলকবহর বহদ্দারহাট সাংগঠনিক ওয়ার্ড জামায়াতের অনুষ্ঠানে সিবগাতুল্লাহ আকাশকে দেখা গেছে। তিনি ওই ওয়ার্ডের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন— এমন জানা গেছে কয়েকটি সূত্রে। আকাশ তারও আগে চট্টগ্রাম নগরীর একটি ওয়ার্ডে ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন।
পুরনো দাগী
সিবগাতুল্লাহ ওরফে আকাশ চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে সাতকানিয়া উপজেলার দক্ষিণ চরতি এলাকার যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ওরফে বগা হত্যামামলার ২০ নম্বর আসামি তিনি। চট্টগ্রামের তৃতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে পিবিআই তদন্ত করছে। আকাশের বিরুদ্ধে এছাড়া নারী হয়রানিসহ বিস্ফোরক মামলাও রয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালে শিবিরের মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কেন্দ্রীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সুপারিশে তিনি দ্রুতই ছাড়া পান। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন কর্মীকে মারধরের অভিযোগে আকাশের সাতকানিয়ার বাড়িতে সেনাসদস্যরা গেছেন বেশ কয়েক দফায়।
স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি সাতকানিয়া উপজেলায় টেন্ডার বাণিজ্য করতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন আকাশ।পরে এর প্রতিবাদে নিজের সমর্থকদের নিয়ে বিক্ষোভও করেন তিনি।
অভিযোগ মিলেছে, আকাশের প্রভাব খাটিয়ে তার বাবা সাবেক কাউন্সিলর নেচার উদ্দিন মাটির অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে বেশ কয়েক দফায় সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সতর্কও করা হয়।
সিপি