মানব ইতিহাসে অসংখ্য জ্ঞানী, দার্শনিক ও সংস্কারক জন্ম নিয়েছেন। কেউ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে অবদান রেখেছেন, কেউ ন্যায়নীতি ও সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে মানবজাতিকে আলোকিত করেছেন। তবুও এমন একজন মহান ব্যক্তি আছেন, যিনি সব সময় শ্রদ্ধা ও ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন—তিনি হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মরুভূমির নিঃসঙ্গতায় তিনি বিশ্বশান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। তার দয়া ও করুণা ছিল সীমাহীন। এমনকি যারা তাকে অস্বীকার করত বা তার সঙ্গে শত্রুতা করত, তাদের প্রতিও তিনি মানবিক মমতা প্রদর্শন করেছেন।
আল্লাহ রাব্বুলআলামিন মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তার মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি মানবতার মুক্তির মহান অগ্রদূত। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসুলের মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (সুরা আহজাব : ২১)। তার প্রতিটি কথা, কাজ, নির্দেশনা ও উপদেশ মানব জীবনের দিকনির্দেশক। তিনি শুধু ব্যক্তিগত জীবনের শিক্ষক নন, সমগ্র মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক।
সমাজের অরাজকতা ও মানবিক সংকট
হযরত মুহাম্মদ (সা.)র জন্মের সময় আরব সমাজে নৈতিক ও সামাজিক অরাজকতা ছিল। গোত্রের মধ্যে কোন্দল, মারামারি, হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, ব্যভিচার, মদ্যপান ও কন্যা শিশু হত্যার ঘটনা দৈনন্দিন ছিল। নারী-পুরুষের মর্যাদা অল্পই বিবেচিত হতো। ঠিক এই অন্ধকার যুগে জন্ম নেন মহানবী (সা.), যিনি মানবজাতিকে মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করবেন। তার জীবন আজও মানবজীবনের জন্য এক অনন্য উদাহরণ।
নবুয়্যতের প্রাপ্তি ও ইসলামের প্রচার
নবুয়্যতের প্রাপ্তির পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের মূল বার্তা প্রচার শুরু করেন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহই উপাস্য এবং মুহাম্মদ (সা.) তার প্রেরিত রাসূল। এই সত্য প্রচারের পথে তিনি বহু বাধা ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। মক্কার কিছু মানুষ তাকে হত্যারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মহানবী (সা.) নির্ভীক ছিলেন। কোনো বাধাই তাকে সত্য ধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
প্রথম মুসলিমরা ছিলেন হযরত খাদিজা (রা.) এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। ইসলামের আলো ক্রমশ চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মহানবী মুহাজির ও আনসারের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন। মুহাজিররা হলেন যারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, আর আনসাররা স্থানীয় মুসলমান যারা তাদের আশ্রয় ও সহায়তা প্রদান করেন। মদিনায় হিজরত করে তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এখানে মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকে এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন সম্ভব হয়। এরই অংশ হিসেবে তিনি মদিনার সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটিই ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত এবং এটি পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
বিদায় হজ্ব: সমগ্র মানবতার জন্য শিক্ষা
দশম হিজরীতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় হজ্ব পালন করেন। এটি তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব, যা ‘বিদায় হজ্ব’ নামে পরিচিত। প্রায় একলক্ষ মুসলিম এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আরাফাত ময়দানে পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি মুসলিম উম্মাহকে উদ্দেশ্য করে একটি চিরস্মরণীয় ভাষণ দেন। তিনি ঘোষণা করেন, মুসলিমরা একে অপরের ভাই। ইসলাম জাতিগত, বর্ণগত, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভেদাভেদকে স্বীকৃতি দেয় না। নারী-পুরুষ সমান অধিকারপ্রাপ্ত, দাস-দাসীর প্রতি কর্তব্য স্পষ্ট এবং সকলকে ন্যায়বিচারের অধিকার রয়েছে।
শেষ দিন ও বিশ্বশান্তির বার্তা
হজ্ব শেষে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। কয়েক মাসের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হন। যতদিন শক্তি ছিল, নামাজে যোগ দিয়ে জনগণকে শিক্ষাদান অব্যাহত রাখেন। পরে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)কে নামাজের ইমামতি করার নির্দেশ দেন। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়ালে ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মদিনা শরীফে মসজিদে নববীতে আজও কোটি কোটি মুসলিম ভক্তি-ভরে তাঁর রওজা জিয়ারত করে।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন; তিনি মহান মানবতাবাদী, সংস্কারক এবং বিশ্বশান্তির দূত। তার জীবন ও শিক্ষার অনুসরণই শান্তি, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ। কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)। প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য হলো নবীজি (সা.)এর জীবন ও শিক্ষা অনুসরণ করে তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করা। মাহে রবিউল আউয়াল এই মহান ব্যক্তির আগমনের বার্তা উপলক্ষে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মাস। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে নবীজি (সা.)এর সুন্নত ও আদর্শকে অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট