চট্টগ্রাম নগরের জিইসি এলাকার এক পার্লারের বাথরুম থেকে বিউটিশিয়ানের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাথরুমের শাওয়ারে ওড়নার সঙ্গে পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছিল মরদেহটি। এমনকি পা ছিল মেঝের সঙ্গে প্রায় লাগানো। পুলিশ এটিকে ডিপ্রেশনের কারণে আত্মহত্যা বললেও পরিবারের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যা। মৃত্যুর সঠিক কারণ কি, তার উত্তর মিলছে না। এ ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
এছাড়া পার্লারের মালিক ঘটনাস্থলে থাকলেও ‘ব্যস্ততা’ দেখিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে এড়িয়ে যান। তার বক্তব্য জানতে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কথা বলা যায়নি। পরে প্রতিবেদক পার্লার মালিকের স্বামীর বক্তব্য নিতে গেলে বাধা দেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে নগরীর জিইসি ‘নাদিয়া’স মেকওভার’ নামে একটি পার্লারে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত বিউটিশিয়ানের নাম প্রিয়াঙ্কা দত্ত (৩৫)। তিনি ‘নাদিয়াস মেকওভার’ পার্লারে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাঁশখালীর বাসিন্দা সঞ্জিত দত্তের স্ত্রী।
নীল শাড়ি পড়া হলো না প্রিয়াঙ্কার
প্রিয়াঙ্কার শখ ছিল নীল শাড়ি পড়ে পরিবারের সঙ্গে দুর্গা পূজায় আনন্দ করবেন। সেজন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে করেছেন পূজোর বাজার, কিনেছেন নিজের জন্যে একটি নীল শাড়িও। কিন্তু সেই শাড়ি আর পড়া হলো না। শখ পূরণের আগেই তিনি পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে।
প্রিয়াঙ্কার নীল শাড়ি নিয়ে আক্ষেপ উঠে এসেছে তার ব্যক্তিগত ডায়েরির লেখায়ও। সেখানে তিনি লেখেন, ‘নীল শাড়িটা তো পড়লাম না, একটু পড়িয়ে দিও।’ তবে এ লেখাটি তিনি কখন লিখে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরিবার, কর্মস্থান, স্বামী-সন্তান—সবকিছুই নিয়ে সুখের সংসার ছিল প্রিয়াঙ্কার। মৃত্যুর দিনেও জীবিকার তাগিদে গিয়েছিলেন অফিসেও।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, প্রিয়াঙ্কাকে বেশ অস্থির লাগছিল। মোবাইলে বেশ চ্যাটিং করছিলেন তিনি।
পরিবারের দাবি হত্যা
প্রিয়ঙ্কার মা জানান, তার মেয়ে খুবই ভালো ছিল। সকালেও হাসিমুখে অফিসে গিয়েছে। এমন কোনো বিষয় হয়নিই যে, সে আত্মহত্যা করবে। তিনি ধারণা করছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যা। এমনকি তিনি তার মেয়ের পার্লারে কর্মরত, একজন মেয়ের সঙ্গে খুব বাকবিতণ্ডার কথাও শুনতে পান।
প্রিয়ঙ্কার ছেলে সজীব দত্ত জানান, তার মাকে ঘটনাস্থলে যেভাবে দেখতে পায়, তা কোনোভাবে আত্মহত্যার মতো মনে হয়নি। ছেলের দাবি, বাথরুমের ঝর্ণার সঙ্গে ফাঁস দেওয়া যায় না। ঝর্ণা কী মানুষের ভার নিতে পারবে?
প্রিয়াঙ্কা ডায়েরীর পাতায় পাতায় লেখা ছিল, বুকে জমে থাকা কষ্টের কথা। জানান দিয়ে, আদরের পুত্র ও স্বামীকে ভালোবাসার কথা। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর পর আমাকে, কাটাছিড়া করবেন না। বাসা বাইরে, সবজায়গায় চাপমুক্ত থাকা দরকার। আমি আপাতত এইসব আর নিতে পারছি না।
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া ডায়েরীর পাতায় আরও লেখা ছিল, সজীব তোমাদের বড় ছেলে দেখে রাখিও। মাম্মার আশা পূরণ করিও, মানুষ হবে রোবট নই। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, তুমি আমার মনার, বন্ধু বাবা হবে। অনেক সময় দিবে। আমার মা বাবা ভাইয়ের, তুমিই ভরসা। আমার জায়গাটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। ড্রিংকস করিও না, ছেলেটাকে তুমি মানুষ করবে।
প্রিয়াঙ্কার ছেলে এসব তার মায়ের হাতের লেখা বলে পুলিশকে নিশ্চিত করলেও পরিবারের দাবি, লেখাগুলোর ফরেনসিক করা হোক।
‘এতো দায়িত্ব কেন, আমি শান্তি চাই’
প্রিয়াঙ্কার রেখে যওয়া ডায়েরিতে নিজের মানসিক অস্থিরতার কথা লিখে যান। দায়িত্বের চাপে দিন দিন পিষে মরতে থাকা প্রিয়াঙ্কা শান্তি চান। তিনি লেখেন, আমার বাড়িতে আমাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখে আসিও। আচ্ছা আমি কি, পাগল হয়ে যাচ্ছি? দায়িত্বের সাথে আর পেরে উঠছি না। এতো দায়িত্ব কেন, আমার আমি শান্তি চাই। জাস্ট রিলেক্স।
ছেলে সজীবকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, বাবা আমাকে ক্ষমা করিস। আমি তোর যোগ্য মা হতে পারলাম না। তবে মনা তুমি, মাম্মার যোগ্য সন্তান।
তিনি আরও লেখেন, আচ্ছা আমি তো খু্ব বেশি কিছু চাই না। একটু সময়, ভালোবাসা। একাত্ব মানুষকে ধ্বংস করে। আমি তে ধ্বংস চাইনি, ভালোবাসা চেয়েছি। টাকার লোভী তো আমি কখনো না। আমার কাছে টাকার চেয়েও মানুষ বড়। ভালোবাসা বড়, সময় বড়।
পুলিশের ধারণা ‘আত্মহত্যা’
পাঁচলাইশ থানা পুলিশ জানায়, বিউটি পার্লারে গিয়ে বাথরুমের দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। আর বাথরুমের শাওয়ারের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলানো ছিল প্রিয়াঙ্কার লাশ। এরপর সেটি উদ্ধার করা হয়। তার ডায়েরি লেখা পড়ে এ ঘটনাকে তারা আত্মহত্যা বলে ধারণা করছে।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলাইমান জানান, আমরা ধারণা করছি, এটি ডিপ্রেশনের কারণে আত্মহত্যা।
ডিজে