সূর্যের দেশে ভিটামিন ‘ডি’র রোগী বাড়ছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে পরীক্ষা বন্ধ, প্রাইভেটে দ্বিগুণ খরচ

ডাক্তার ছাড়া ওষুধ সেবনে কিডনির ঝুঁকি

চট্টগ্রামে ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতিজনিত সমস্যা বেড়েই চলেছে। জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর নানান শারীরিক জটিলতার সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই সমস্যা। এই ঘাটতি মেটাতে ডাক্তার রোগীদের ভিটামিন ‘ডি’ ট্যাবলেট নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেক সময় ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই ভিটামিন ’ডি’ খেতে বলেন রোগীদের। ভিটামিন ‘ডি’র মাত্রা পরীক্ষার ফি বেশি হওয়ায় অনেক রোগীরা ডাক্তার না দেখিয়েই ওষুধ খেয়ে নেন। প্রাইভেট ল্যাবে এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ থাকলেও কেমিক্যালের অভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক মাস ধরে বন্ধ ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষা।

অথচ আমাদের দেশে আবহাওয়া সমভাবাপন্ন এবং গ্রীষ্মে রোদের তীব্রতাও থাকে প্রখর। ভিটামিন ‘ডি’র প্রধান উৎস এই রোদ। কিন্তু এরপরও করোনার পর থেকে মানব শরীরে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠেছে ভিটামিন ‘ডি’র সমস্যা।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, ভিটামিন ‘ডি’ কম থাকার লক্ষণ দেখা দিলে রক্তে এর মাত্রা পরীক্ষার পরামর্শ দিই আমরা। তবে ভিটামিন ডি’র ব্যবহার যদি অতিরিক্ত হয়ে যায় তাহলে রোগীর জন্য বিপদ।

জটিল রোগ পরবর্তী বাড়ছে সমস্যা

করোনা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন জটিল রোগ-পরবর্তী পেশি ব্যথাসহ নানান সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে প্রায় রোগীর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’র ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষাও লিখে দিচ্ছেন। এরপর রোগীর প্রেসক্রিপশনে ভিটামিন ‘ডি’ ৪০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ আইইউ’র উচ্চ মাত্রার ডোজও দেওয়া হচ্ছে।

ডাক্তারদের মতে, ভিটামিন ‘ডি’ আসলে একটি স্টেরয়েড হরমোন, যা শরীরে প্রোটিন তৈরিতে নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় থাকে এবং এর ঘাটতি হলে শিশু থেকে বয়স্ক—সবারই নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীরে এর ঘাটতি হলে শিশুদের রিকেট রোগ হয় অর্থাৎ পা বেঁকে যেতে পারে, মাথার খুলি বড় হয়ে যেতে পারে।

বেশিদিন এই রোগে ভুগলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে পারে। আবার বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাড়ক্ষয় কিংবা ব্যথাসহ নানান সমস্যা তৈরি হয় ভিটামিন ডি-র অভাব থেকেই। একইসঙ্গে বেড়ে যায় দৈহিক ওজন কিংবা প্রয়োজনীয় ওজন না হওয়ার সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক (আরপি) ডা. এসএম রিয়াসাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বহির্বিভাগ থেকে জ্বর, শরীর ব্যথার জন্য ভিটামিন ‘ডি’ দেওয়া হয় না। তবে ওল্ডএজের নারী-পুরুষকে ভিটামিন ‘ডি’ দেওয়া হয়। তবে তা অবশ্যই পরীক্ষা করে। কিন্তু রোগীরা হাসপাতালে না এসে, ল্যাবে বেশি খরচের ভয়ে পরীক্ষা করে না। নিজ বুদ্ধিতেই ভিটামিন ‘ডি’ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেন। যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করলে কিডনিতে পাথর হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘রোগীদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। ডাক্তাররা অবশ্যই ভিটামিন ‘ডি’ ট্যাবলেট দেওয়ার আগে সব বিষয়ে বিবেচনা করবেন। হোমজিক্যালি ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করা যাবে না।

চট্টগ্রাম মেডিকেল ল্যাবে বন্ধ পরীক্ষা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কেমিক্যালের অভাবে বন্ধ রয়েছে ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষা। ফলে মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। প্রাইভেট ল্যাবগুলোতে এ পরীক্ষার দাম মেডিকেলের দ্বিগুণ। তাই অনেকে টাকা খরচের ভয়ে পরীক্ষা না করিয়েই ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খাচ্ছেন।

চট্টগ্রামের পপুলার, শেভরণ, ইপিকসহ বিভিন্ন ল্যাবে ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষা করানো যায়। যা সাধারণত একটি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের ২৫-হাইড্রোক্সিভিটামিন ‘ডি’ [25(OH)D] এর মাত্রা পরিমাপ করে।

পাঁচলাইশের শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের জেনারেল ম্যানেজার পুলক পারিয়াল বলেন, ‘ভিটামিন ডি’র পরীক্ষা বর্তমান সময়ে কিছুটা বেড়েছে। কিছুদিন আগেও সেটি ছিল না। তবে খরচ বেশি হওয়ায় রোগীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন এ পরীক্ষায়।’

ডা. এসএম রিয়াসাদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ল্যাবে ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি মাসখানেক আগে থেকে কেমিক্যাল শেষ হওয়ায় বন্ধ রয়েছে কার্যেক্রম। হাসপাতালের ল্যাবের এ পরীক্ষা করতে আড়াই হাজার টাকা খরচ হতো রোগীদের, যা প্রাইভেট ল্যাবের প্রায় অর্ধেক।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘ভিটামিন ‘ডি’ পরীক্ষা করার কেমিক্যালের টেন্ডার আহ্বান করা হবে। আমরা পত্রিকায় শীঘ্রই বিজ্ঞপ্তি দিব। আশা করছি, মাস দুয়েকের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।’

যেভাবে মিলবে ভিটামিন ‘ডি’

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, একটা মানুষের শরীরে কতটুকু ভিটামিন ‘ডি’ প্রয়োজন, তা নির্ভর করে তার বয়স ও স্বাস্থ্যের ওপর। শরীরে ভিটামিন ‘ডি’র মাত্রা জানতে রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। সাধারণত মাত্রা নির্ধারণের কাজটিকে চারটি ভাগে দেখা যায়। শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ মাত্রা ২০ এনজি/এমএলের (ন্যানোগ্রাম/মিলিলিটার) নিচে থাকলে তা ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ফলে হাড়ের দুর্বলতাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে।

শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘ডি’র মাত্রা হলো ২০ থেকে ৫০ এনজি/এমএল, যা হাড়, দাঁতসহ স্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত। ৫০ থেকে ৮০ এনজি/এমএল ভিটামিন ‘ডি’-কে উচ্চ তবে নিরাপদ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত সাপ্লিমেন্ট গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে এমন মাত্রা দেখা যায়। ১০০ এনজি/এমএলের বেশি হলে ভিটামিন ‘ডি’ শরীরের জন্য বিষাক্ত হতে পারে, যা কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়া শরীরে হাইপারক্যালসেমিয়াসহ অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণত সকাল ১০টার পর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময়টুকুতে সূর্যের আলোর সাথে যে রশ্মি আসে, সেটা শরীরের জন্য বেশি উপকারি। শহরে সেভাবে সম্ভব না হলেও অন্তত হাত ও পায়ে যেন সূর্যের আলো লাগে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

সূর্যের আলো ভিটামিন ‘ডি’র একমাত্র উৎস কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ভিটামিন ‘ডি‘র অন্যতম খোরাক। কিন্তু এর বাইরে দুধ, কুসুমসহ ডিম এবং চর্বিযুক্ত খাদ্যে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে। এছাড়া মাছ, ডিম, দইয়ের মত খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যায়।’

অতিরিক্ত ভিটামিন ‘ডি’ সেবনে বিপদ

ডাক্তাররা বলছেন, পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন ‘ডি’ সেবন করলে রোগীর শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। ফলে কিডনি পাথর হতে পারে।

অতিরিক্ত ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করলে কি ক্ষতি হতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. জয় বলেন, ‘সূর্যের আলো ও ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার থেকেও এই অভাব পূরণ না হলে, আছে ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক। এই সাপ্লিমেন্ট বাজারে পাওয়া যায় ট্যাবলেট আকারে। কিন্তু অনেক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই এসব সাপ্লিমেন্ট খেয়ে থাকেন। ভিটামিন ‘ডি’ শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিনের অভাবে যেমন নানা সমস্যা দেখা দেয়, তেমনি না জেনে-বুঝে ইচ্ছেমতো ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণে উপকারের বদলে অপকারই বেশি।’

অতিরিক্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ করলে কী হয়—এই প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইউরোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে প্রতিদিন ৪ হাজার আইইউ’র (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট) বেশি ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করলে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। এতে রক্তে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম তৈরি হয়। তার মধ্যে একটি ঝুঁকি হাইপারক্যালসেমিয়া। এটি হলে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘পেশির ব্যথা ও হাড়ের অস্বস্তিও হয়। রক্তে অত্যাধিক ক্যালসিয়াম জমলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এথেরোস্ক্রোসিস বা ধমনি অনমনীয় হয়ে যায়। তাই বয়স্ক এবং হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া এতে কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রক্তে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কিডনিতে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে কিডনিতে পাথর বা ক্যালসিয়াম জমা হতে পারে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm