চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর ট্রান্সক্রিপ্ট নিয়ে অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এক ছাত্রীর সকল তথ্য পরিবর্তন করে ছাত্রের নামে করা হয়েছে। সেখানে জিপিএ, গ্রুপ, স্কুল ছাড়া অন্য সব তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। অনলাইনেও মুহূর্তে বদলে গেছে ট্রান্সক্রিপ্টের তথ্য। এসব তথ্য পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ স্বাক্ষর করেছেন চট্টগ্রাম বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এ ঘটনায় বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ গেছে। সেই অভিযোগে ট্রান্সক্রিপ্ট পরিবর্তনের জন্য ১০ লাখ টাকার লেনদেন করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
‘লাভলী’ হয়ে গেল ‘পিয়াল’
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন খাগড়াছড়ির গুইমারার শহীদ লে. মুশফিক হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন সাদিয়া জাহান লাভলী। সেখানে তার রোল নম্বর ছিল ৭১২৭৬৮। লাভলীর বাবার নাম লিটন হাওলাদার, আর মা শাহানারা বেগম। জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ৩১ আগস্ট ২০০৬ এবং ফলাফল ছিল জিপিএ ৩.৭৮। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে বদলে যায় সকল তথ্য। অনলাইন ফলাফলে দেখা যায়, লাভলীর জায়গায় রয়েছে পিয়াল আশরাফ শান্তর নাম। বাবা ও মায়ের নামের জায়গায় রয়েছে মো. মিজানুর রহমান এবং পারুল বেগম। বদলে যায় জন্ম তারিখ ও লিঙ্গ। তবে হুবহু রয়ে যায় ফলাফল।
নিয়ম না মেনে বড় পরিবর্তন
সাদিয়া জাহান লাভলীর মূল ট্রান্সক্রিপ্টে লাল কলম দিয়ে পরিবর্তিত নামগুলো আর জন্ম তারিখ লিখে পাশে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক স্বয়ং। তিনি লেখেন, ‘Assistant Program Pl. do necessary action to show website’ এবং নিচে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসঙ্গে এত বড় পরিবর্তনের কোনো নিয়ম নেই। যদি নাম, পিতা-মাতার নাম বা জন্ম তারিখ সংশোধন করতে হয় তাহলে সর্বপ্রথম এফিডেভিট করতে হয়। এরপর সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়, তারপর বোর্ড ফি জমা দিতে হয় এবং সবশেষে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রমাণ্য কাগজপত্র জমা দিতে হয়। পরে বোর্ডর নাম সংশোধন কমিটি তা উপস্থাপন করে যাচাই-বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত নেয়, ট্রান্সক্রিপ্ট পরিবর্তন করার জন্য যথাযথ তথ্য প্রমাণ আছে কিনা। এরপরে গিয়ে ট্রান্সক্রিপ্ট পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু সাদিয়া জাহান লাভলীর ক্ষেত্রে এসবের কিছু না মেনে সরাসরি পিয়াল আশরাফ শান্তর নামে সনদপত্র তৈরি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, ‘শহীদ মুশফিক স্কুল থেকে গত ২৪ আগস্ট ভুল সংশোধনের আবেদন আসে। এটা যেহেতু আমাদের কম্পিউটার সেন্টারের ভুল হয়েছে, সেজন্য বিষয়টি দ্রুত সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে।’
স্বাক্ষরে গরমিল
২০২৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় শান্ত, এমন দাবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের। কিন্তু পরীক্ষা কেন্দ্রের উপস্থিতি স্বাক্ষরপত্রের সঙ্গে যে প্রকৃত পরীক্ষার্থীর নামের মিল ছিল না। সেই বিষয়ে কোনো ধরনের লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি বোর্ডে বরাবরে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, শান্ত যদি পরীক্ষা দিয়ে থাকে, তাহলে লাভলীর স্বাক্ষরপত্রে সে কিভাবে স্বাক্ষর করলো?
১০ লাখ লেনদেনের অভিযোগ
লাভলী থেকে শান্তর নামে ট্রান্সক্রিপ্ট পরিবর্তনের এই কাজে ১০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে ড. মো. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন নাঈম চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি।
অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভীষণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা-২৮৪ এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের অধীনে শহীদ লে. মুশফিক হাইস্কুলের পরীক্ষার্থী সাদিয়া জাহান লাভলী, রোল : ৭১২৭৬৮, রেজিস্ট্রেশন নং : ২১১৪৪৬৯২১৭ এর সকল তথ্য ১০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে বোর্ডের চিহ্নিত কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিবর্তন করে পিয়াল আশরাফ শান্তর নামে সনদপত্রাদি তৈরি করা হয়েছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করছি।
সংশোধনে নিয়ম মানা হয়েছে কিনা এবং ১০ লাখ টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, ‘ওই ছেলের কলেজের ভর্তি সময় কম ছিল, বিষয়টি তাড়াতাড়ি সমাধান না করলে তার এক বছর লস হয়ে যেতো। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব সেটা সমাধান করা হয়েছে। আর ছেলেটা খুবই গরিব তার কাছে চট্টগ্রামে এসে এগুলো পরিবর্তন করারও টাকা ছিল না। আমরা আরও যাওয়ার সময় তার গাড়ি ভাড়ার জন্য ২০০ টাকা দিয়েছি। সেখানে ১০ লাখ টাকা সে কোথায় থেকে দেবে?’
যা বলছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা
এ বিষয়ে শহীদ (লে.) মুশফিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছাম্মত কামরুন নাহার জানান, ‘পিয়াল ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী। পিয়ালের প্রবেশপত্রে তার ছবির জায়গায় একটি মেয়ের ছবি প্রিন্ট হয়। কিন্তু তারপরও সে যথারীতি পরীক্ষা সম্পন্ন করে এবং গণিতে ফেল করে। ছবির বিষয় নিয়ে আমরা বোর্ডে আবেদন করি। পরে এ শিক্ষার্থী ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরমপূরণ করে গণিত বিষয়ের জন্য। পরীক্ষার কয়েক দিন আগে প্রবেশপত্র আসার পর দেখি, পিয়ালের ছবি ঠিক থাকলেও এখানে সাদিয়া জাহান লাভলী নাম এসেছে। এমনকি ওই শিক্ষার্থীর পিতার নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ পর্যন্ত চলে আসে। তখন আবারও শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করা হয়।’
৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি
এ ঘটনায় অভিযোগ দেওয়ার পর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, এ ঘটনার সত্য তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
ডিজে