২২ দিনমজুরের এনআইডি হাতিয়ে চট্টগ্রামে ২৫০ কোটির ঋণ কেলেঙ্কারি, হতভম্ব গ্রামবাসী

ইউসিবি চকবাজার শাখার ঋণ কেলেঙ্কারি

কক্সবাজার ও বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার ২২ জন দরিদ্র দিনমজুরের নামে চট্টগ্রামের চকবাজার শাখার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখানো হয়েছে। অথচ ভুক্তভোগীরা জীবনে কোনোদিন ব্যাংকে যাননি, এমনকি ঋণের কাগজপত্র কেমন দেখতে তাও জানেন না।

ইউসিবির ভেতরে-বাইরে যোগসাজশে ২৫০ কোটি টাকা লোপাট! ফাঁস হলো বড় চক্র
ইউসিবির ভেতরে-বাইরে যোগসাজশে ২৫০ কোটি টাকা লোপাট! ফাঁস হলো বড় চক্র

সংঘবদ্ধ এক প্রতারক চক্র ও ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশে এভাবে সংঘটিত হয় ভয়ঙ্কর এক আর্থিক প্রতারণা।

করোনাকালে এনআইডি সংগ্রহ, পরে দিনমজুরের নামে কোটি কোটি টাকার ঋণ
করোনাকালে এনআইডি সংগ্রহ, পরে দিনমজুরের নামে কোটি কোটি টাকার ঋণ

করোনাকালের ‘অনুদান’ ফাঁদে এনআইডি

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১–২২ সালে করোনাকালে সরকারিভাবে ত্রাণ ও সহায়তার খবরে স্থানীয় মিজানুর রহমান ও নুর বশর নামে দুই ব্যক্তি ঈদগড়, বাইশারী ও আশপাশের দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন।

‘আমার ঘরে চাল নেই, অথচ নাকি কোটি টাকার ঋণ নিয়েছি’—ভুক্তভোগীদের করুণ আর্তনাদ
‘আমার ঘরে চাল নেই, অথচ নাকি কোটি টাকার ঋণ নিয়েছি’—ভুক্তভোগীদের করুণ আর্তনাদ

অনুদান ও চাকরির প্রলোভনে তাদের পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, ইংরেজিতে লেখা ফরমে স্বাক্ষর করানো হয়, যা তারা পড়তে বা বুঝতে পারেননি। পরে তাদের হাতে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু বছর দুয়েক পর তাদের হাতে আসে ইউসিবি চকবাজার শাখার ঋণ পরিশোধের নোটিশ। কাগজে দেখা যায়, কারও নামে ১০ কোটি, কারও নামে ২০ কোটি, এমনকি নুরুল ইসলাম নামের এক দিনমজুরের নামে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণও।

প্রতারণার শিকারদের করুণ অবস্থা

ঈদগড়ের বাসিন্দা দরিদ্র দিনমজুর নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জীবনে ব্যাংকে যাইনি, অথচ এখন শুনছি কোটি টাকার ঋণ নিয়েছি। আমার ঘরে চাল কেনার টাকা নেই।’

রামুর গর্জনিয়ার মিজানুর রহমানও ঋণের নোটিশ পাওয়ার পর মানসিক চাপে ২০২৩ সালে স্ট্রোক করে মারা যান। তার স্ত্রী এখন তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এরা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অথচ তাদের নামে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেখানো হয়েছে।’

২২ দিনমজুরের নামে ২৫০ কোটি ঋণ

ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ঈদগড়ের আবুল কালাম, নুর বশরের ভগ্নিপতি দীর্ঘদিন পটিয়ায় থাকার সুবাদে পরিচিত হন প্রতারকচক্রের মূল সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের সঙ্গে। তাদের নেতৃত্বেই ২২ জনের নামে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ঋণ তোলা হয়। আবুল কালাম ও নুর বশরের নিজের নামেও প্রায় ২০ কোটি টাকার ঋণ দেখানো হয়েছে।

চক্রটি চট্টগ্রামের নন্দনকাননের জেকে টাওয়ারে অফিস ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চালাতো, পরে অফিস সরিয়ে নেয় তিনপুলস্থ বি অ্যান্ড বি টাওয়ারে। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, এখান থেকেই ব্যাংকের নথি আনা-নেওয়া ও লেনদেন হতো।

দিনমজুররা হঠাৎ কিভাবে জমি-ব্যবসার মালিক?

ইউসিবি চকবাজার শাখায় গিয়ে জানা যায়, নতুন ম্যানেজার সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। ঋণ মঞ্জুরের সময় দায়িত্বে থাকা অপারেশন ম্যানেজার হোসনে মোবারক জিকু বলেন, ‘জায়গা ছাড়া তো ব্যাংক মর্টগেজে ঋণ দেয় না, সব ডকুমেন্ট জমা দিয়েই নিয়েছে।’ কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি—প্রত্যন্ত গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ হঠাৎ কিভাবে কোটি কোটি টাকার জমি বা ব্যবসার মালিক হলেন।

ব্যাংকিং আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট রমিজ আহমেদ বলেন, ‘এটি পরিকল্পিত জালিয়াতি। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে-বাইরে যারা জড়িত, সবাই দায়ী। এটি অর্থপাচারের বড় উদাহরণ।’

কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন সাবেক মন্ত্রী জাবেদ ও তার স্ত্রী

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন ও আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। গত ৭ আগস্ট দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করা হয়।

দুদক জানায়, আরামিট গ্রুপের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সাইফুজ্জামানের আত্মীয় সৈয়দ নুরুল ইসলামকে মালিক সাজিয়ে ‘ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স’ নামের কাগুজে প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। ভুয়া কাগজপত্রে ২০১৯ সালে ইউসিবির জুবিলী রোড শাখায় হিসাব খোলা হয় এবং ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তা নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনে ভূমিকা রাখেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে ২৪ কোটি টাকা বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর ও রিভারসাইড এন্টারপ্রাইজের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হয় এবং ১ কোটি টাকা নগদে তোলা হয়। দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, আসামিরা যোগসাজশে ভুয়া তথ্য ও জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং করেছেন।

এই মামলায় সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমীলা জামান, আত্মীয় সৈয়দ নুরুল ইসলাম, আরামিট গ্রুপ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন, ইউসিবির সাবেক কর্মকর্তাসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।

জেজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm