চট্টগ্রামের শিল্প এলাকা আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় কর্মক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। ৮ মাসে শুধু আনোয়ারা থানায় রেকর্ড করা হয়েছে ১১টি ধর্ষণ মামলা, যার মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনায় শ্রমিক ও সাধারণ নারীরা আতঙ্কিত। ভুক্তভোগীদের মধ্যে কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েই রয়েছে। ঘটনার ধরনে বারবার চোখে পড়ে চাকরির প্রলোভন, পথচারী, পরিবহন এবং আবাসিক বাড়ি—এসব জায়গায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
মামলা থেকে মামলায় বেড়ে চলা যৌন সহিংসতা
আনোয়ারা থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ১১টি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ধর্ষণের ঘটনা এর চেয়েও বেশি ঘটেছে, যার বেশিরভাগই পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। অনেক নারী লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনা চেপে যেতে বাধ্য হয়েছে।
চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি: বাড়তি বিয়ে দেখানো প্রলোভনে বারশত ইউনিয়নের সিইউএফএল হাউজিং কলোনীতে এক যুবতীকে ধর্ষণের অভিযোগে সিইউএফএলের এক কর্মচারী মো. রিমন হোসেন (২৮) গ্রেপ্তার হন। ২ মার্চ দক্ষিণ শোলকাটা, লাবিবা ক্লাব সংলগ্ন স্থানে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়; পুলিশ বলেছে, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
২৯ মে থেকে ৩১ মে: বারশত-বটতলী এলাকায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রী (১৫) তিন দিন ধরে ধর্ষণের শিকার হন; মামলার পর ১ জুন চায়ের দোকানের একজন কর্মচারী মো. কায়সার (২০) গ্রেপ্তার করা হয়। কায়সারের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের সলিমাপাড়া এলাকায় বলে পুলিশ জানায়।
১৯ জুন: কেইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য এসে বাড়ি ফেরার পথে এক তরুণী সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার পরে সেখানে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়; এই ঘটনায় বটতলী ইউনিয়নের বরৈয়া গ্রামের সিএনজি চালক ফোরকান (৩২) ও মো. হানিফ (৩৫) গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের সময় সিএনজির ভেতর তল্লাশি চালিয়ে ভুক্তভোগীর একটি কানের দুল উদ্ধার করেছে পুলিশ, যা একটি আলামত হিসেবে পাওয়া যায়।
২৬ জুন: চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে আনোয়ারা থেকে নিয়ে বোয়ালখালীতে নিয়ে এসে ধর্ষণ করা হয়েছে। খবর পেয়ে বোয়ালখালীর কালুরঘাট আমতল, নবাব আলী চৌধুরীর বাড়ির একটি ভাড়া বাসা থেকে অভিযুক্ত মোহাম্মদ বাবুকে (২৬) গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়।
২৩ জুনে একটি পৃথক ঘটনায় জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের এক ১৩ বছর বয়সী কিশোরী তার নিজ বাড়িতেই ধর্ষণের শিকার হন। প্রায় দুই সপ্তাহ পর থানায় অভিযোগ দায়ের করলে ৮ জুলাই পুলিশ অভিযুক্ত মোহাম্মদ বাবুকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে।
৪ ও ৫ আগস্ট: বারশত বোয়ালিয়া ঈদগাঁরের পাশে এনামুল নামে এক যুবক চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুই দফায় এক নারীকেও সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে; ৬ আগস্ট মামলার পর পুলিশ এনামুল হক, প্রকাশ রিপন, সাইফুদ্দিন ও কাশেমকে গ্রেপ্তার করে।
সাম্প্রতিক ঘটনা: ২৪ আগস্ট বটতলী ইউনিয়নে এক কিশোরীকে তার নিজ ঘর থেকে অপহরণ করে পশ্চিম বরৈয়া ডিউরি রাস্তায়, বিলের পাশে বাউন্ডারি ওয়ালের পরিত্যক্ত টিনশেড ঘরে ১০ ঘণ্টা আটকে রেখে ১৪ বছর বয়সী ওই কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার করা হয়; ঘটনার আগে-পরের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এক নারীসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। থানার সূত্রে জানা যায়—অতিরিক্তভাবে থানায় আরও তিনটি ধর্ষণচেষ্টার মামলা রয়েছে।
শিল্পাঞ্চলে অন্ধকার জগত
স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, শুধুমাত্র বাইরের অপরাধীরাই নয়, কেইপিজেডভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মীও অনৈতিক কাজে জড়িত আছেন। তারা শ্রমিক পরিচয়ে আবাসিক বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে কাজের আড়ালে অনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেকে কষ্ট করে আসেন আর সেই দুর্বলতা অসৎ কাজে লাগানো হচ্ছে।
আনোয়ারা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী কুসুম বলেন, ‘কারখানায় কর্মরত কিছু শ্রমিক অনৈতিক কাজ করছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারখানা এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হবে।’
তারা যা বললেন
অর্গানাইজেশন ফর উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ওডেব)-এর এরিয়া অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু এ সময়ে হয়রানি ও বিভিন্ন রকমের নির্যাতনও বেড়েছে। আনোয়ারা একটি শিল্পবাণিজ্যিক উপজেলা। দিন দিন সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে, কিন্তু নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই তুলনায় অনেক কম। প্রশাসন যদি নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়, কিছুটা হলেও অপরাধ প্রবণতা কমবে।”
জাতীয় মহিলা সংস্থার আনোয়ারা উপজেলার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় যখন এই বিষয়গুলো দেখি, খারাপ লাগে। এগুলো যদি সঠিক বিচারের আওতায় আনা হয়, তবে নারী সহিংসতা ও নির্যাতন অনেকটাই কমে আসবে।’
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শিরিন ইসলাম বলেন, ‘আনোয়ারা উপজেলা চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রশাসন এই বিষয়ে গুরুত্বসহকারে কাজ করছে। পূর্বে অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে চাপচক্র থাকলেও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের তৎপরতায় সেই সুযোগ বিলোপ হয়েছে।’
কেইপিজেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনির হোসেন জানান, ‘আনোয়ারা থানায় গত ৮ মাসে ১১টি মামলা রুজু করা হয়েছে। আমরা অভিযোগ বা তথ্য পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। এই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি।’
এক ভুক্তভোগীর আর্তনাদ
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এক কিশোরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরিবারের অভাব-অনটন দেখে সচ্ছলতা পেতে হালিশহর থেকে আনোয়ারার কেইপিজেডে চাকরির সন্ধানে এসেছিলাম। সেখানে এক অমানুষের খপ্পরে পড়ে আজ আমার ইজ্জত হারিয়ে গেছে।’