দেশ ছাড়ার পর জাবেদের তিন সন্তানের দেশত্যাগে এলো নিষেধাজ্ঞা, একজন এস আলমের পুত্রবধূ

দেশ ছাড়ার প্রায় বছরখানেক পর অবশেষে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের তিন সন্তানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

রোববার (২২ জুন) ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দিয়েছেন।

ওই আদেশে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের দুই ছেলে তানায়েম জামান চৌধুরী, সাদাকাত জামান ও মেয়ে জেবা জামান। জেবা জামান এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর পুত্রবধূ।

রোববার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় দুদকের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন।

আবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাত সদস্যের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে দুদক জানতে পেরেছে। শুনানি নিয়ে আদালত তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন।

দেশে নেই জাবেদ পরিবার

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার আগে ও পরে জাবেদের তিন সন্তানই লন্ডনে চলে গেছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে কিংবা পরে সাইফুজ্জামান জাবেদ নিজেও ভারত হয়ে লন্ডনে চলে যান বলে জানা গেছে। সর্বশেষ লন্ডনে তার অবস্থান শনাক্ত করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারে সর্বশেষ ভূমিমন্ত্রী ছিলেন এবং চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইসঙ্গে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী। জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির বিরুদ্ধেও বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

সম্পত্তি জব্দ যুক্তরাজ্যে

চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সব সম্পত্তি জব্দ করেছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ সংস্থা (এনসিএ)। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার তদন্তকারী ইউনিটকে (আই-ইউনিট) দেওয়া এক বিবৃতিতে এনসিএ-এর একজন মুখপাত্র জব্দকরণের আদেশ নিশ্চিত করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘চলমান সিভিল তদন্তের অংশ হিসেবে এনসিএ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বেশ কয়েকটি সম্পত্তি জব্দকরণের আদেশ পেয়েছে।’

এনসিএ জব্দ করার ফলে এখন সাইফুজ্জামান চৌধুরী এসব সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।

এর আগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন সম্পদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে বাংলাদেশ। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিদেশে ৫৭৫০ কোটি টাকার সম্পদ

বিশ্বজুড়ে সাইফুজ্জামান জাবেদের সম্পত্তি নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের (আই-ইউনিট) অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নসে’ বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা) মূল্যের সম্পদ কিনেছেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টির বেশি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সাইফুজ্জামান জাবেদ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের (প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা) বাড়িতে বসবাস করছেন।

সাইফুজ্জামান জাবেদ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক। ওই সম্পত্তির মূল্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। তার স্ত্রী রুকমিলা জামান দুবাইয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক।

সরকারি তদন্তের অন্যতম টার্গেট

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়। এরপর থেকে অন্তর্বতী সরকার বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ উদ্ধারে তদন্ত করছে। এই তদন্তের অন্যতম টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামান বিশ্বজুড়ে ৬০০টিরও বেশি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক।

গত বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-কে চিঠি দিয়ে সাইফুজ্জামান, তার স্ত্রী রুখমিলা জামান, মেয়ে জেবা জামান এবং দুই ছেলে তানাইম জামান চৌধুরী ও সাদাকাত জামান-এর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য চেয়েছিল দুদক। এর আগে ওই বছরের ১২ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুখমিলা জামান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার নির্দেশ দেয়।

ব্রিটিশ এমপির চিঠি

গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ সংস্থাকে (এনসিএ) চিঠি দেন দেশটির ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আপসানা বেগম।

চিঠিতে এমপি আপসানা বেগম জানান, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কর জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংস্থাটি দাবি করেছে যে, তিনি যুক্তরাজ্যে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছেন। এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি এবং ইউকে কোম্পানি হাউসের রেকর্ডগুলোর বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো ১৫ কোটি পাউন্ডেরও বেশি মূল্যের কমপক্ষে ২৮০টি সম্পত্তি অর্জন করেছে। আল-জাজিরার তদন্তে জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী আমার নির্বাচনী এলাকা পপলার ও লাইমহাউজে ৭৪টি সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm