চট্টগ্রামের ফল ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মার জুনুনি। চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে চিকিৎসা করানোর কথা বলে তিনি সহযোগীদের নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। তাকে বাসা ভাড়া নিয়ে দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেন এক সরকারি লোক। তিনি বাড়ির কেয়ারটেকারকে পরিচয়পত্রও দেখান। এক মাস ১০ দিন পর তারা ওই বাসা বদলে একই ভবনের অষ্টম তলার বাসা ভাড়া নেন। তার সঙ্গে আসা লোকেরা ছিলেন তার বডিগার্ড।
আতাউল্লাহর প্রতিবেশিরা জানান, কারও সঙ্গে মিলতো না আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীরা। তবে মাঝে মধ্যে ইমরান নামে এক যুবক বাসা থেকে বের হতো বাজার করার জন্য। এছাড়া আতাউল্লাহকে তারা বেশ কয়েকবার ডাক্তারের ফাইল নিয়ে যাওয়া-আসা করতে দেখেছেন।
সোমবার (১৭ মার্চ) মধ্যরাত দেড়টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমি পল্লী আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কের ১০ তলা ‘ভূমি পল্লী টাওয়ার’র অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে আতাউল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ওই ফ্ল্যাটে তার পরিবারের সদস্য ও ছয় সহযোগী ছিলেন। ওইদিন রাতে ময়মনসিংহ নতুন বাজার এলাকার ১৫ তলা গার্ডেন সিটির ১০ তলার ফ্ল্যাট থেকে দুই নারী এবং দুই পুরুষকেও গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এ ঘটনার পর ওই ভবনের ফ্ল্যাটের মালিকেরা নিজ নিজ ফ্ল্যাটে সিসি ক্যামেরা লাগাচ্ছেন। ভবনের এক ফ্ল্যাট মালিক জানান, আমরা কেউ তাদের চিনতেও পারিনি। যদি তারা আমাদের জিম্মি করে ফেলতেন তাহলে কি অবস্থা হতো। যারা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন তারা দায় এড়াতে পারেন না।
ভূমি পল্লী টাওয়ারের ১০ তলা ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের মালিক চট্টগ্রামের ফল ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম। তবে ফ্ল্যাটটি দেখাশোনা করেন তার শ্বশুর হুমায়ুন কবীর।
হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমার বাসাটি ভাড়া নিতে আতাউল্লাহর সঙ্গে আরও দুই ব্যক্তি এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে সেনা কর্মমকর্তা ও আরেকজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছিলেন। ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার আগে আমি যখন পরিচয়পত্র চাচ্ছিলাম, তখন ওই দুজনের সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি নিজেকে আতাউল্লাহর আত্মীয় বলে জানান। তখন তারা বলেছিলেন, পরিচয়পত্র বুঝে দেবেন। আর সাংবাদিক যিনি ছিলেন, তিনি চাকমা বংশধর। রোহিঙ্গা যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি নিজেকে চট্টগ্রামের ট্রলার ও মাছের ব্যবসায়ী পরিচয় দেন। বলেছিলেন, উনি অসুস্থ হওয়ায় ঢাকার পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় উঠেছিলেন গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি (আরসা প্রধান)। তার সঙ্গে ১২ বছরের একটা ছেলে আর আনুমানিক ৩৪-৩৫ বছরের আরেকজন। উনারা মোট এক মাস ১০ দিন ছিলেন আমাদের বাসায়। পরে আমাকে দুই মাসের ২৪ হাজার টাকা ভাড়া পরিশোধ করে ফ্ল্যাটটি তাদের জন্যে ছোট হয়ে যায় বলে ওপরের আরকেটা ফ্ল্যাটে ভাড়ায় উঠেছিলেন। এজন্যই আমি আর পরে তাদের পরিচয়পত্র নেইনি।’
সেনা কর্মকর্তা আর সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে আপনার পরে আর যোগাযোগ হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাড়িওয়ালা বলেন, ‘না, উনারা আর আসে নাই। রোহিঙ্গা এই লোককে যখনই দেখতাম উনি লাঠির ওপর ভর করা। আরেকজনের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতেন। পরশুদিন র্যাব ধরার পর দেখি উনি পুরাপুরি সুস্থ। অথচ এতদিন হাঁটতেই পারতেন না।’
তিনি আরও জানান, ১ মাস ১০ দিন পর তারা বাসাটি ছেড়ে দিয়ে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় ওপরে অষ্টম তলার বাসায় ওঠে যান। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাসাটি তারা ছেড়ে দেন বলে জানান। তবে তারা দুই মাসের ভাড়া দিয়ে দেন। তবে তারা নিয়মিত নামাজ পড়তেন। একবার লুঙ্গি বিছিয়ে নামাজ পড়তে দেখে আমি আতাউল্লাহকে একটি জায়নামাজও দেন তিনি এবং একবার তার পেছনে নামাজও পড়েন।
অষ্টম তলার ওই ফ্ল্যাটটির মালিক ইতালিপ্রবাসী হালিম সরকার। সেটি দেখাশোনা করেন খোরশেদ আলম নামে তার এক আত্মীয়। তিনি জানান, তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকার কারণে তাদের অষ্টম তলার বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। তারা নামাজ পড়তেন, তাদের কথাবার্তা ও চলাফেরায় রোহিঙ্গা বলে মনে হয়নি।
চার মাস আগে জুব্বা ও মাথায় টুপি পরা আতাউল্লাহসহ চার–পাঁচজন ফ্ল্যাটে ওঠেন বলে জানান ভূমি পল্লী টাওয়ারের নিরাপত্তা প্রহরী ইমরান আলী। তিনি জানান, একজনের কাঁধে হাত দিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ফ্ল্যাটে ওঠেন আতাউল্লাহ। তবে তিনি খুব কম বের হতেন। সময়মতো বাসা ভাড়া পরিশোধ করে দিতেন। কয়েক দিন পর পর আত্মীয় পরিচয়ে লোকজন আসতো বাসায়। সোমবার রাত ৮টার দিকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে আতাউল্লাহর স্ত্রী শাহীনা আক্তার, দুই সন্তান এখানে আসেন।
এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহীনুর আলম জানান, আতাউল্লাহর সঙ্গে আটক হওয়ার ব্যক্তিরা তার বডিগার্ড। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের পর র্যাব-১১–এর ওয়ারেন্ট অফিসার শাহনেওয়াজ বাদি হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে দুটি মামলা করেন। মামলা দুটিতে আতাউল্লাহসহ ছয়জনকে ৫ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তবে তিন থেকে আট বছর বয়সী পাঁচ শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তারা মায়েদের সঙ্গে আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।