সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিজিট ও কর্মী ভিসা প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি একটি অনলাইন ওয়েবসাইট ‘ইউএই ভিসা অনলাইন’-এর খবরে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হলেও, দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস এই খবরকে ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে মন্তব্য করেছে।
দূতাবাসের ব্যাখ্যা ও বাস্তবতা
১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশসহ নয়টি দেশের নাগরিকদের জন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত ভিজিট ও কর্মী ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে আমিরাত সরকার। এর কারণ হিসেবে নিরাপত্তা, ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক এবং কোভিড-১৯ মহামারীর ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়। খবরটি প্রকাশের পর বাংলাদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় এবং বিষয়টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের নজরে আসে।
এই খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এই খবরের কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমিরাত সরকার থেকে কোনো সংবাদ পাইনি। এটি সংশ্লিষ্ট ভিসা সেন্টারের একটি দুরভিসন্ধিমূলক কাজ হতে পারে।”
দূতাবাসের সর্বশেষ বিবৃতি
সম্প্রতি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাস নিশ্চিত করেছে যে এই খবরটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দূতাবাস জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এই মিথ্যা খবরের মূল উৎস হলো ‘uaevisaonline.com’ নামের একটি ভুয়া ওয়েবসাইট। এই ওয়েবসাইটটি নিজেদের একটি ভিসা প্রসেসিং সেন্টার হিসেবে পরিচয় দিলেও দূতাবাসের তদন্তে এর প্রতারণার বিষয়টি সামনে এসেছে।
দূতাবাসের তদন্তে দেখা গেছে, ‘uaevisaonline.com’ ওয়েবসাইটটি একাধিক দেশের ঠিকানা ব্যবহার করে থাকে। এর নিবন্ধকের ঠিকানা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে, কারিগরি যোগাযোগের নম্বর যুক্তরাজ্যে এবং কোম্পানির যোগাযোগের নম্বর ভারতে অবস্থিত।
ওয়েবসাইটটিতে দুবাইয়ে যে প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে সেই ঠিকানায় কোনো ভবন বা বাসার অস্তিত্ব নেই। এছাড়া, এই কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহক প্রতারণার একাধিক অভিযোগও দূতাবাসের কাছে এসেছে। অনেক গ্রাহক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
দূতাবাস বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসরত সকল বাংলাদেশি নাগরিককে এই ধরনের ভিত্তিহীন সংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। একই সঙ্গে সকলকে যেকোনো তথ্য বা সংবাদ প্রচার এবং শেয়ার করার আগে এর সত্যতা যাচাই করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
বন্ধ থাকা ভিসা: নেপথ্যে জুলাই অভ্যুত্থান
যদিও ২০২৬ সালের ভিসা নিষেধাজ্ঞার খবরটি অসত্য, তবে গত বছর জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিক্ষোভের পর থেকেই ভিজিট ও কর্মী ভিসা বন্ধ করে দেয় ইউএই। সে সময় আমিরাত সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা চিঠি না দিলেও, ভিসা সাবমিট সিস্টেম ব্লক করে দেওয়া হয়। তৎকালীন ইউএই কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন এই তথ্য নিশ্চিত করেন। গত বছর ২২ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ভিসা সিস্টেমে বাংলাদেশিদের জন্য ভিজিট ও কর্মী ভিসা ব্লক রয়েছে।
ওই বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে ৫৭ জন বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর পরই সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা এখনো চলমান। বর্তমানে শুধু ‘হাই-প্রফেশনাল’ ভিসা চালু আছে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও নীরব আমিরাত
বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিট’-এ আমিরাতের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি কর্মী নেওয়ার আহ্বান জানান। তবে এ পর্যন্ত আমিরাত সরকার এ বিষয়ে কোনো নমনীয়তা দেখায়নি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। গত বছর ভিসা বন্ধের পর দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমেছে। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার বাংলাদেশি কর্মী ভিসায় আমিরাতে গেছেন। এই ভিসা জটিলতা কাটিয়ে উঠতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও, ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমিরাতের ভূমিকা এখনো নীরব।