মুমিনের মহান গুণ: বিনয় ও নম্রতায় জীবনের সৌন্দর্য

বিনয় ও নম্রতা মানুষের চরিত্রের এমন এক গুণ, যা একজন মুমিনকে আল্লাহর নিকট প্রিয় ও মানুষের মাঝে সম্মানিত করে। এটি শুধু নৈতিক সৌন্দর্য নয়, বরং এক জীবন্ত ব্যক্তিত্বের আলোকবর্তিকা। বিনয়ী মানুষ অহংকার থেকে মুক্ত থাকে, অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে, দয়া ও সহমর্মিতার মাধ্যমে মানবিক সম্পর্ককে দৃঢ় ও সুগভীর করে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের বন্ধু হলো আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং বিনয়ী হয়।’ (সূরা মায়িদা: ৫৫) এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বিনয়ীরা আল্লাহর বিশেষ বন্ধু। অর্থাৎ, আল্লাহ তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য, মর্যাদা এবং প্রিয়তার যোগ্য বানান।

বিনয়ী মানুষের মর্যাদা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে মর্যাদাবান করে। বিনয়ী ব্যক্তি নিজেকে তুচ্ছ মনে করতে পারে, তবে মানুষের চোখে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। তার প্রতিটি কথা, ওঠা-বসা, হাঁটাচলা, এমনকি নীরব আচরণও মার্জিত ও প্রভাবশালী হয়। কোরআনে এভাবে উল্লেখ আছে, ‘আর তাঁরাই করুণাময়ের বান্দা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (সূরা ফুরকান: ৬৩)

বিনয়ী ব্যক্তি কটু কথা ও গালাগালার জবাবও ভদ্র ও শান্তভাবে দেয়। তাদের মধ্যে অহংকার নেই; বরং তারা সদা নম্র, ধৈর্যশীল এবং শান্তপ্রিয়। আল্লাহ বিনয়ীদেরকে প্রকৃত বান্দা বলেন, কারণ তারা মানবিক ও ঈশ্বরীয় মর্যাদা উভয়েই ধারণ করে।

নম্রতার প্রকৃতি ও মূল

বিনয় শব্দের অর্থ হলো নম্রভাব, কোমলতা, মিনতি ও বিনীতচেতা মনোভাব। নম্রতা হলো ঔদ্ধত্যহীনতা, অবনত চিত্ত, শান্তশিষ্ট ও কোমল স্বভাব। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেছেন, “বিনয় ও নম্রতার মূল হলো তোমার দুনিয়ার সম্পদকে এমনভাবে গ্রহণ করা যাতে তা কারো ওপর অহংকার সৃষ্টি না করে, আর উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে মিশে তাকে বোঝাতে পারা যে সে তোমার ওপর মর্যাদাবান নয়।”

রাসুলুল্লাহ (সা.): বিনয় ও নম্রতার প্রতিচ্ছবি

যদি কখনও বিনয় ও নম্রতার সর্বোচ্চ উদাহরণ খুঁজতে হয়, তবে তা হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন; তবুও তিনি সর্বাধিক বিনয়ী, দয়ালু ও সহমর্মী ছিলেন। হাদিসে বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন তিনি প্রথম সুপারিশ করবেন, তবে এতে কোনো গর্ব নেই। তাঁর হাতে ‘হামদ’-এর পতাকা থাকবে; তবুও অহংকারের কিছু নেই। এই উদাহরণ আমাদের শিক্ষা দেয় যে মর্যাদা ও ক্ষমতার সঙ্গে বিনয়ী হওয়া সম্ভব এবং এটি মানুষকে সত্যিই মহান করে তোলে।

বিনয় ও সামাজিক প্রভাব

বিনয়ী ব্যক্তির মধ্যে দয়া, প্রেম, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারিতা ও প্রতিশ্রুতিপালন থাকে। ফলে তারা পরিবারের, সমাজের ও দেশের কল্যাণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিনয়ী মানুষ সহজেই অন্যদের ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করে। এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক উন্নতিরও গুণমান বৃদ্ধি করে।

জান্নাতি মানুষের বৈশিষ্ট্য

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমি কি তোমাদের জান্নাতি মানুষের সংবাদ দেব না? তারা সরল, নম্র, ও কোমল চিত্তের লোক। মানুষ তাদের দুর্বল মনে করে, তবে আল্লাহ তাদের সত্যপথে প্রতিষ্ঠিত করেন।” আর বিপরীতে, জাহান্নামের মানুষ অহংকারী, বদমেজাজি ও ঝগড়াটে। এটি স্পষ্ট করে যে, বিনয় ও নম্রতা কেবল নৈতিক গুণ নয়, জান্নাতি বৈশিষ্ট্যের অংশ।

বিনয়ী হয়ে ওঠার শিক্ষা

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে এমনভাবে বসতেন যাতে অপরিচিত ব্যক্তিও সহজে তাঁকে চিনতে না পারে। এভাবে তিনি প্রমাণ করেছেন যে বিনয় ও নম্রতা মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানায়। বিনয়ী না হলে জীবন জ্বলন্ত অহংকারে ভরা থাকে। একজন সত্যিকারের সফল ব্যক্তি সেই, যার মধ্যে দয়া, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা ও সহমর্মিতার সঙ্গে বিনয়, নম্রতা ও সততার সমন্বয় থাকে।

বিনয় ও নম্রতার বিপরীত হলো ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার ও হিংসা। এগুলো মানুষের চরিত্রের নিকৃষ্ট দিক। পৃথিবীর অশান্তি ও সংঘাতের মূলেও এই নেগেটিভ গুণাবলী অবস্থান করে। তাই প্রকৃত আল্লাহর বান্দা হতে হলে বিনয়ী হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বিনয়কে নিজের চরিত্রে ধারণ করে, সে দুনিয়াতে ও আখেরাতে সম্মান ও ভালোবাসা অর্জন করে।

উপসংহার

বিনয় ও নম্রতা একজন মুমিনের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু নৈতিক গুণ নয়, বরং জান্নাতি বৈশিষ্ট্যও। আল্লাহ আমাদের সকলকে বিনয়ী হওয়ার তাওফিক দান করুন। বিনয় ও নম্রতার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে, মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয় এবং সমাজকে সুস্থ ও কল্যাণময় করে।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm