দেশের ব্যাংক খাতের সংকটের পেছনে এক ব্যক্তির অবদানকে কেন্দ্র করে তীব্র অভিযোগ করেছেন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করেছেন। ‘জম্বি ব্যাংক’ ১৫টি ব্যাংকের অর্ধেকের ওপর সরাসরি লুটপাট হয়েছে।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় এমন অভিমত ওঠে আসে। অনুষ্ঠানে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘একজন মাত্র ব্যক্তি যেমন একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দিতে পারে। উল্টোভাবে এক-দুজন সৎ পরিচালকও একটি ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট।’
তিনি বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, যার প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৬০টি ব্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি স্থানীয়। এসব ব্যাংকের প্রায় ৪০টি মানসম্মত নয় এবং এর মধ্যে ১৫টি ‘জম্বি ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত। এসব ব্যাংকের অর্ধেকের ওপর সরাসরি লুটপাট হয়েছে।
মাসরুর আরেফিন আরও বলেন, নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি শেয়ার মালিকানার কারণে, বৈধ শেয়ার মালিকানা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন এবং ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্যানেল আলোচনায় ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, বর্তমানে ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া, তারা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, রেটিং এজেন্সিগুলো কী বলেছিল? দুর্নীতি দমন কমিশন কী করেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো কী বলছে? প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা চাকরি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয়ে অনিয়মে সায় দিয়েছেন।
তিনি বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘হুইসেলব্লোয়িং’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একইভাবে রেটিং এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, আর্থিক খাতের সংস্কার জটিল ও ব্যয়বহুল। দেশে কিছু ভালো ব্যাংক থাকলেও বেশ কিছু জম্বি ব্যাংক রয়েছে, যেখানে খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। তিনি ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংস্কারের গুরুত্বারোপ করে বলেন, এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে পারবেন এবং বোর্ড সদস্যদের মেয়াদ কমিয়ে ৬ বছর করা উচিত।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ব্যাংক খাতের সংকট এখনও কাটেনি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পরিমাণ অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ছিল ৩.৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যা ২০২৫ সালের জুনে আরও ১.৫ ট্রিলিয়ন টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৩০-৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।