চট্টগ্রামে ডাক্তারবাড়ির অন্ধকার গল্প: মাদকাসক্ত বেকার ছেলে, প্রতারিত বউ, নিহত অনাগত শিশু

নামকরা চিকিৎসক দম্পতির বড় ছেলে—বেকার, শিক্ষাজীবন থমকে গেছে এসএসসিতেই, একসময় হারিয়ে যায় মাদকের জগতে। কিন্তু সমাজের চোখে সম্মান অটুট রাখতে, নিজের ছেলের এই অন্ধকার সত্য লুকিয়ে যান অভিভাবকরা। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণীকে বিয়ের ফাঁদে ফেলে দেন।

শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তরুণী টের পায় ভয়ংকর বাস্তবতা। স্বামী যে মাদকাসক্ত আর বেকার, তা তো বুঝতে পারে, কিন্তু তার থেকেও বড় আঘাত আসে শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতারণা উপলব্ধি করে। তখন আর কিছুই করার ছিল না তার, পেছনে ফেরার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

এরপর শুরু হয় দুঃস্বপ্নের জীবন—বেকার স্বামীর অকারণ নির্যাতন, আর শ্বশুর-শাশুড়ির নীরব সমর্থন। ধীরে ধীরে এই সংসার পরিণত হয় নরকে। শেষমেশ, যখন সে গর্ভে একটি নতুন প্রাণ ধারণ করে, তখনও দয়া মেলেনি। একদিন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে হাসপাতালের বিছানায় হয় তার ঠাঁই। সেই দিনই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিভে যায় তার অনাগত সন্তানের প্রাণ।

মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের বিভীষিকা পেরিয়ে, ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির অভিযোগ এনে স্বামী, শাশুড়ি ও শ্বশুরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সেই তরুণী। তার অসহ্য যন্ত্রণা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী সিদ্ধান্ত আদালত গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে।

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সকালে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক ফেরদৌস আরার আদালতে এই ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন নির্যাতনের শিকার তরুণী।

অভিযুক্তরা হলেন—তরুণীর স্বামী ফাহিম আহমদ (২৪), শাশুড়ি ডা. শামীমা আক্তার (৫০) এবং শ্বশুর ডা. আশফাক আহমদ (৬৫)। তারা সবাই চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ হাউজিং সোসাইটির স্যানমার নভেলা হাসিন ভবনের বাসিন্দা। এর মধ্যে শ্বশুর ডা. আশফাক একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, আর শাশুড়ি ডা. শামীমা মেমন মাতৃসদনে কর্মরত, পাশাপাশি সদরঘাটে একটি চেম্বারও পরিচালনা করেন।

তরুণী ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী। আল হিয়াদাহ্ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে এ-লেভেল শেষ করে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ২০২৪ সালের জুন-জুলাই সেশনে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ডা. আশফাকের ফ্ল্যাটের ওপরের একটি শিশুকে টিউশন করাতেন। সেই সুবাদে চিকিৎসক দম্পতির নজরে আসেন তিনি। পরে খোঁজখবর নিয়ে তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান আশফাক-শামীমা দম্পতি।

বিয়ের সময় তারা আশ্বস্ত করেন, ছেলের চাকরি আছে, কোনো যৌতুক বা ফার্নিচারের প্রয়োজন নেই এবং বিয়ের পরও পুত্রবধূর উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকবে। এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে তরুণী ও তার পরিবার বিয়েতে সম্মতি দেন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ১৫ লাখ টাকা দেনমোহরে ফাহিম আহমদের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের আয়োজন, ৩০০ অতিথি আপ্যায়নসহ সব মিলিয়ে ৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সত্য উন্মোচিত হয়। তরুণী জানতে পারেন, স্বামী বেকার, অলস ও বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। এরপরই শুরু হয় নতুন নাটক—ফাহিম তার বাবা-মাকে খুশি করতে ১০ ভরি স্বর্ণ ও সেগুন কাঠের ফার্নিচার দাবি করতে থাকে। কিন্তু তরুণীর পরিবার এই দাবি না মানায়, শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে জোর করে তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঁচলাইশ হাউজিং সোসাইটির স্যানমার নভেলা হাসিন ভবনের বাসিন্দাদের কয়েকজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ওই সময় ফাহিম মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে বলে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছেন।

নির্যাতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে, গত ১৭ মার্চ রাতে ফাহিম ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে। তরুণী অপারগতা প্রকাশ করলে শুরু হয় কথাকাটাকাটি, যা মুহূর্তেই রূপ নেয় ভয়ংকর সহিংসতায়। ফাহিম তার তলপেটে লাথি মারে, আর শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে কিল-ঘুষি চালায়। চরম আঘাতে গুরুতর আহত হলেও কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি।

শেষমেশ প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে নিজেই রিকশায় করে ন্যাশনাল হাসপাতালে যান তরুণী। সেখানে তার অবস্থা দেখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসা নেন, শারীরিক ক্ষতের পাশাপাশি মানসিক ট্রমা নিয়েও লড়াই করতে থাকেন।

অবশেষে নিজের সম্মান আর ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ে নামেন তরুণী। মামলার এজাহারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ১১ (গ)/৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ৩১৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm