চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল করে জুয়া-চাঁদাবাজি, ব্যবস্থা নিতে তথ্য উপদেষ্টাকে আট সাংবাদিক সংগঠনের আহ্বান
আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বিএনপিকে দায়ী
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল করে গত একবছর ধরে সেখানে জুয়া চলছে—এমন খোলামেলা মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা তথ্য উপদেষ্টার স্পষ্ট বক্তব্যের প্রশংসা করছেন। তার বক্তব্যের পরদিনই চট্টগ্রামের আটটি সাংবাদিক সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে তথ্য উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবকে ক্লাবকে লুটেরা ও দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘প্রেস ক্লাব যেভাবে দখল হয়ে বসে আছে। চিটাগাং প্রেস ক্লাবের ইস্যু আমি গত এক বছরে সলভ করতে পারিনি। বিকজ অফ দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ ইনভলভমেন্ট দেয়ার। ওখানে পলিটিক্যাল পার্টি, এবং ওখানে জুয়া চলে, ওখানে আরও কী কী চলে। আমি ওগুলো ডিসিকে বলে বন্ধ করতে পারছি কিছুটা। কিন্তু এই যে প্রেসক্লাবের ইস্যুটা ওখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে এটা এখনও… একটা নির্বাচন হয়নি। এক বছরে একটা নির্বাচন হয়নি, প্রেসক্লাবে, চিটাগাং প্রেসক্লাবে। সো, দিস ইজ দ্য রিয়েলিটি…’

দফায় দফায় হামলা চালিয়ে প্রেসক্লাব দখল
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা অন্তত ৪ দফা– ৫, ৬, ১২ ও ১৪ আগস্ট হামলা চালিয়ে প্রেস ক্লাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দেশীয় অস্ত্র, হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ফটকের তালা ভেঙে তারা বার বার ক্লাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। এরপর পুরো ক্লাব দখল করে নেওয়া হয়। এ সময় তারা পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর নারকীয় হামলা চালায়।
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২৪-২৫-এ সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একটি দল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে হামলা চালায় এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করে, যাতে অন্তত ২০ জন আহত হন।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে প্রায় ১৩ মাস ধরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব একটি সুযোগসন্ধানী চক্রের দখলে রয়েছে। দখলের পর চট্টগ্রামের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি অবৈধভাবে ভেঙ্গে দিয়ে নিজে আহ্বায়ক হয়ে ৪ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করেন। বিএনপির অঙ্গসংগঠন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রাম শাখার আহ্বায়ক জাহিদুল করিম কচি নিজেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব ঘোষণা করেন। প্রেসক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি অভিযোগ করেছে, মব সৃষ্টির মাধ্যমে সহিংসভাবে দখল নেওয়ার পর তার নেতৃত্বে ক্লাবের সম্পদ ও নিয়মিত আয় থেকে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ তুলেছে।
উপদেষ্টাকে ৮ সাংবাদিক সংগঠনের অভিনন্দন
এদিকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল ও অচলাবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে অভিনন্দন জানিয়ে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন আট সংগঠনের নেতারা। এরা হলেন- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহসভাপতি শহীদ উল আলম ও যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা ও সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ, চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সভাপতি খোরশেদ আলম ও সম্পাদক যীশু রায় চৌধুরী, চট্টগ্রাম টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাসিরুদ্দিন, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক রাজেশ চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলতাফ, টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম মামুন।
প্রেসক্লাব ফেরত চান পেশাদার সাংবাদিকরা
বিবৃতিতে বলা হয়, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় ভাঙচুর ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে এ ক্লাব দখল করা হয়। ওই সময় চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নীরব অবস্থান নেয়। দখলে নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা হয়নি। বর্তমানে প্রশাসনের নাকের ডগায় সপ্তাহে চার দিন ক্লাব প্রাঙ্গণে জুয়ার আসর বসছে। লুট হয়ে যাচ্ছে ক্লাবের নিয়মিত আয়ের বড় একটি অংশ। গোপনে চলছে ক্লাবের বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেওয়ার নামে গোপন চুক্তির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতা।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এ পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাংবাদিক নেতারা বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর হলেও প্রেসক্লাবের বাস্তব পরিস্থিতি প্রকাশ করায় আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই। তবে অনুরোধ করছি, হাল না ছেড়ে এ ক্লাবকে দখলদার ও লুটেরাদের হাত থেকে মুক্ত করে দ্রুত একটি নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নিন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এর ফলে জেলা প্রশাসককে ব্যানারে রেখে অন্তর্বর্তী কমিটির অপর তিন সদস্য এ ক্লাবকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। দখলদারদের চালবাজিসহ নানা বিষয় টের পেয়ে ডিসি এ কমিটি থেকে সরে যান। কিন্তু খণ্ডিত কথিত কমিটি বর্তমানে নানা অপকর্মের জাল আরও বিস্তৃত করেছে। গঠনতন্ত্রের বিধিবিধান না মেনে তারা এ ক্লাবের ৯৬ জন স্থায়ী সদস্যের সদস্যপদ বাতিল ও স্থগিত করেছে। এর পাশাপাশি মনগড়াভাবে অযোগ্য, অসাংবাদিকসহ অনেক অপরাধীকেও ক্লাবের কথিত সদস্যপদ দিয়েছে, যা গঠনতন্ত্র বহির্ভূত ও অবৈধ।
সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করেন, প্রেসক্লাব বর্তমানে চাঁদাবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দখলদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কথিত নতুন সদস্যপদ পাওয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভয়ভীতি ও চাপ সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করছে। এমনকি চাঁদাবাজি, ক্লাবের প্যাড ব্যবহার করে অনৈতিক ডিও লেটার দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় কয়েকজন কথিত সাংবাদিক গ্রেফতারও হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, দখলদারদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে চট্টগ্রামে কর্মরত সব সাংবাদিক প্রেসক্লাবে আসা-যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। তবে সাধারণ সদস্যরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়েই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সাংবাদিক নেতারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান, অনতিবিলম্বে দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ২৮৩ জন স্থায়ী সদস্যকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা হোক।
আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে বিএনপিকে দায়ী
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) তাদের দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২৪-২৫-এ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে। ‘বাংলাদেশ: গণতন্ত্র পুনর্গঠন’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার সময় ২০ সাংবাদিকের ওপর নারকীয় হামলার ঘটনার ওপর। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের প্রাচীন এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা অন্তত ৪ দফা– ৫, ৬, ১২ ও ১৪ আগস্ট হামলা চালিয়ে প্রেস ক্লাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দেশীয় অস্ত্র, হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ফটকের তালা ভেঙে তারা বার বার ক্লাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। এরপর পুরো ক্লাব দখল করে নেওয়া হয়।
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একটি দল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে হামলা চালায় এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করে, যাতে অন্তত ২০ জন আহত হন।’
আইএফজে তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশন (আইএফজে) হলো বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর বৃহত্তম গ্লোবাল ইউনিয়ন ফেডারেশন। এটি ১৪৬টি দেশের ১৮৭টি সংগঠনের মাধ্যমে ৬ লাখেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আইএফজে বর্তমানে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে সক্রিয়, যা সাংবাদিকদের জন্য বৈশ্বিক কণ্ঠস্বরের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।