কমল চৌধুরী, কক্সবাজারের চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী নিহত দুর্জয় চৌধুরীর হতভাগ্য বাবা। ছেলের মৃত্যু শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন, কাঁদতে কাঁদতে যেন শুকিয়ে গেছে তার চোখের জল। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। একইভাবে ভেঙে পড়েছেন দুর্জয়ের মা। তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবেশীরা। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই যেন তার নাড়ী ছেড়া ধন হারানোর শোক ভুলাতে পারছে না।
শনিবার (২৩ আগস্ট) কক্সবাজারে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধনে কমল চৌধুরী ক্ষোভ ও আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলে দুর্জয় চৌধুরীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলে আত্মহত্যা করেনি। আমাকে যদি দা-ছুরি দিয়ে কেটেও ফেলে তারপরও আমি বিশ্বাস করি না, আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি অবশ্যই আছে। পুলিশের গাফিলতি আছে বিধায় তারা আমদেরকে আইওয়াশ করানোর জন্য তিনজন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদি এরকম না হতো তাহলে পুলিশ প্রত্যাহার করলো কেন? থানার সিসি ফুটেজে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ২২ মিনিট পর্যন্ত তাকে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। এরপরে আর কোনো ভিডিও নাই কেন?
তিনি বলেন, থানায় ফাঁসিতে ঝুলানোর যে ছবি দেখতে পেয়েছি, দুই ইঞ্চি ফাঁক অবস্থায় লোহার গ্রিলে হাত ধরে কীভাবে আত্মহত্যা করা সম্ভব? তাছাড়াও আমার ছেলের ল্যাপটপ ও ব্যাক্তিগত ব্যাগটাও পাচ্ছি না। গত বৃহস্পতিবার আমার ছেলে সকাল সাড়ে ৯টায় অফিসে চলে যান। পরে ওইদিন চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খানম আমাকে সকাল ১১টার দিকে কল করে স্কুলে যেতে বলেন। আমি ১০ মিনিটের মধ্যে স্কুলে যায়। ওখানে গিয়ে দেখি শিক্ষকরা সবাই বসে আছে। সেখানে আমার ছেলে দুর্জয়ও ছিল। এসময় প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খানম বলেন, আপনার ছেলে টাকা আত্মসাৎ করেছে। তখন আমি সকল শিক্ষকের সামনে বলি, আমার ছেলে যদি টাকা আত্মসাৎ করে, আমি সব টাকা পরিশোধ করবো, মুচলেখাও দিবো। প্রয়োজনে ওর চাকরি চলে যাক কিন্তু আপনারা অন্যায়ভাবে কিছু করবেন না। তারপরও কেন ওরা সবাই মিলে আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করলো? তার বিচার আমি চাই।
দুর্জয়ের বাবা বলেন, ওই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খানমের স্কুলের দুর্নীতির সমস্ত ডকুমেন্টস আমার ছেলের ল্যাপটপে আছে। আমার ছেলে উপজেলার মধ্যে সেরা কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে সেরা সনদ পেয়েছে। আমার ছেলের ল্যাপটপে এমন কিছু তথ্য ছিল, যা ফাঁস করে দেবে ভেবে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি শীঘ্রই ছেলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যারা যারা জড়িত সবাইকে আসামি করে আদালতে মামলা করবেন বলেও জানান।
এর আগে শুক্রবার সকালে দুর্জয় চৌধুরীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওইদিন মেডিকেল বোর্ড না থাকায় তার ময়নাতদন্ত হয়নি। পরে শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ৩টার দিকে তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদিন বেলা ৪টার দিকে তার লাশ সামাজিক শ্মশানে সৎকার করা হয়।
কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী উদয় শংকর পাল মিটু বলেন, দুর্জয়ের হত্যার ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে দ্রুত আটক করলে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হবে বলে আশা করছি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটে সেজন্য প্রশাসনকে সজাগ থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খানম ওই স্কুলের অফিস সহকারী দুর্জয় চৌধুরী চেক জালিয়াতি করে ও নগদে প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন মর্মে চকরিয়া থানায় একটি অভিযোগ করেন। চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম ওই অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্জয় চৌধুরীকে হাজতে আটকে রাখেন। পরে ভোর ৪টার দিকে হাজতে ফাঁসিতে ঝুলানো অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করেন চকরিয়া উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব। এসময় তিনি নিহত দুর্জয় চৌধুরীর প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চকরিয়া থানায় অফিস সহকারী দুর্জয় চৌধুরীর আত্মহত্যার অভিযোগে থানার এএসআই হানিফ মিয়াসহ দুই কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র জসিম উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এতে অন্য দুই সদস্য হলেন—চকরিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ও চকরিয়া কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক।
শনিবার দুপুরে থানা হেফাজতে দুর্জয় চৌধুরীর আত্মহত্যার ঘটনায় চকরিয়া থানার ওসিকে বদলি করেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফউদ্দীন শাহীন। তার স্থলে পদায়ন করা হয় তৌহিদুল আনোয়ারকে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চকরিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) অভিজিৎ দাস বলেন, জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী স্যারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই কমিটি কাজ শুরু করেছে। দ্রুত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
ডিজে