জাল সনদে ব্যাংক ভিপি থেকে স্কুল সভাপতির পদ, ২০ বছর ধরে অবাক প্রতারণায় এস আলমের ‘পিএস’

২০ বছরে ৪ ব্যাংক, ৩.৫ কোটির বেশি ‘বেতন-ভাতা’

দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদের একান্ত সচিব। রাতারাতি হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। মোটে এসএসসি পাস করে জাল শিক্ষাগত সনদ বানিয়ে ২০ বছর ধরে দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোতে চাকরি করে এসেছেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদও দখল করে নেন একই প্রতারণার আশ্রয়ে। তবে প্রতারণার সেই গল্প আপাতত এবার শেষ হলো—শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ৫২ বছর বয়সী এই প্রতারককে স্কুল সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এস আলমের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে জাহাঙ্গীরকে।

এই ট্যাবুলেশন শিট পটিয়া কলেজের। আর নিচেরটি বানোয়াট মার্কশিটটি বারইয়ারহাট কলেজে। দুটিই একই দিনের— ১৯৯৬ সালের ১৭ অক্টোবর পটিয়া কলেজ থেকে ফেল করলেও মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট কলেজ থেকে ‘পাস’ করেছেন এইচএসসি!
এই ট্যাবুলেশন শিট পটিয়া কলেজের। আর নিচেরটি বানোয়াট মার্কশিটটি বারইয়ারহাট কলেজে। দুটিই একই দিনের— ১৯৯৬ সালের ১৭ অক্টোবর পটিয়া কলেজ থেকে ফেল করলেও মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট কলেজ থেকে ‘পাস’ করেছেন এইচএসসি!

এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) পদে চাকরিচ্যুত হন জাহাঙ্গীর। জাল সনদে চাকরি করার অভিযোগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে শোকজ করে। জবাব না দিয়ে অনুপস্থিত থাকায় শেষ পর্যন্ত তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে একই জাল সনদের ভিত্তিতে তিনি পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার পদ হারানোর ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

গত রমজানের শেষদিকে সৌদি আরবের মক্কায়ও জাহাঙ্গীর আলমকে দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে। ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে এসে মক্কায় অবস্থান করছিলেন সাইফুল আলম মাসুদও।
গত রমজানের শেষদিকে সৌদি আরবের মক্কায়ও জাহাঙ্গীর আলমকে দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে। ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে এসে মক্কায় অবস্থান করছিলেন সাইফুল আলম মাসুদও।

২০ বছরে ৪ ব্যাংক, ৩.৫ কোটির বেশি ‘বেতন-ভাতা’

জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু ২০০৩ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার হিসেবে। এরপর ২০১৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসএভিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) হন। ব্যাংক খাতের নির্বাহীদের মতে, এই ২০ বছরে তিনি চারটি ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩.৫ কোটি টাকার বেশি বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন।

জাল সনদ ধরা পড়ার পর আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জাহাঙ্গীরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর।
জাল সনদ ধরা পড়ার পর আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জাহাঙ্গীরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর।

তবে চাকরির পাশাপাশি জাহাঙ্গীর মূলত বিতর্কিত শিল্প গ্রুপ এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) হিসেবে কাজ করতেন। আকিজ উদ্দিন ওই পদে আসার আগে জাহাঙ্গীর দীর্ঘ সময় ধরে এস আলমের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, জাহাঙ্গীরের সনদগুলো জাল।
২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, জাহাঙ্গীরের সনদগুলো জাল।

একই দিনে এক কলেজে ফেল, আরেক কলেজে ‘পাস’

জাহাঙ্গীর আলমের দেওয়া সনদ অনুযায়ী তিনি পটিয়ার আব্দুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বারইয়াহাট কলেজ থেকে এইচএসসি, ওমর গণি এমইএস কলেজ থেকে বিএ (পাস) এবং ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস করেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তিনি পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। একই বছর বারইয়াহাট কলেজ থেকে পাসের সনদটি জাল। পটিয়া কলেজের ট্যাবুলেশন শিট ও বারইয়ারহাট কলেজের কথিত মার্কশিট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটিই একই দিনের। ১৯৯৬ সালের ১৭ অক্টোবর পটিয়া কলেজ থেকে ফেল করলেও জাহাঙ্গীর আলম মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট কলেজ থেকে ‘পাস’ করেছেন এইচএসসি!

জাল সনদ শনাক্ত হওয়ার পর ২০২৫ সালের ২১ আগস্ট পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে।
জাল সনদ শনাক্ত হওয়ার পর ২০২৫ সালের ২১ আগস্ট পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে।

অন্যদিকে জাহাঙ্গীর ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস দাবি করলেও ইউএসটিসির একজন শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ নামে কোনো কোর্সই নেই।

জাল সনদে ব্যাংক ভিপি থেকে স্কুল সভাপতির পদ, ২০ বছর ধরে অবাক প্রতারণায় এস আলমের ‘পিএস’ 1

এখন এস আলমের মধ্যস্থতায়

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জাহাঙ্গীরকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে। একটি সূত্র জানায়, তিনি সাইফুল আলম মাসুদের পক্ষ হয়ে তার সম্পদ রক্ষায় নেতাদের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছিলেন। চট্টগ্রামের বোট ক্লাবে মাসচারেক আগে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এস আলমের সাবেক পিএস জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় সেখানে ছিলেন সাতকানিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা জসীম উদ্দিনও।

গত রমজানের শেষদিকে সৌদি আরবের মক্কায়ও জাহাঙ্গীর আলমকে দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে। ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে এসে মক্কায় অবস্থান করছিলেন সাইফুল আলম মাসুদও।

স্কুল সভাপতি পদ হারালেন ৫ মাসেই

চলতি বছরের এপ্রিলে জাহাঙ্গীরকে পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে হলে কমপক্ষে স্নাতক পাস হতে হয়। জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ায় গতকাল তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার স্থলে দ্বিতীয় মনোনীত ব্যক্তি মুহাম্মদ জাহিদুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দুই দশকের প্রতারণার বড় তদন্ত দাবি

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পিআরডি জালাল আহমেদ জানান, জাল সনদে চাকরি বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুতির পর তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা তিনি অবগত নন। তবে ব্যাংক খাতের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।

এদিকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় জাহাঙ্গীরকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান জানান, বোর্ডের চিঠি হাতে পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতারক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তার জাল সনদের ভিত্তিতে ২০ বছর ধরে চাকরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের তদন্তের দাবি উঠেছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm