লাঞ্ছিত সেই মুক্তিযোদ্ধা টাকার অভাবে ‘টেস্ট’ করাতে পারছেন না, দুদিন ধরে চট্টগ্রামে

টাকার অভাবে ‘টেস্ট’ করাতে পারছেন না হামলায় গুরুতর আঘাত পাওয়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানু। চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে এসে গত দুদিন ধরে আছেন এক পরিচিতজনের আশ্রয়ে। মঙ্গলবার তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করলেও সেখানে এসব পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই বলে কর্তব্যরত কর্মচারীরা তাকে জানিয়েছে।

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অজ্ঞাত স্থান থেকে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফেনী মেডিকেলের ডাক্তাররা আমাকে কয়েকটি টেস্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু টেস্টগুলো করানোর মতো টাকা আমার কাছে নেই।’

গত মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানু চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ফেনী থেকে চট্টগ্রামে আসেন। এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার পর প্রাণভয়ে ওইদিনই বিকেল ৫টার আগে এলাকা ছেড়ে তিনি ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ফেনীতে ছেলের বাসায় ওঠেন।

৭৮ বছর বয়সী আবদুল হাই কানু জানান, ডাক্তারের দেওয়া পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও এন্ডোসকপি পরীক্ষা। ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন, হামলায় তার মাথা ও কিডনিতে আঘাত লেগে থাকতে পারে। তার হার্টেও রিং বসানো আছে।

হামলার পর আবদুল হাই কানু অভিযোগ করেছিলেন, ‘জুতার মালা দেওয়ার আগে তারা আমাকে নির্যাতন করেছে। তারা আমার সারা শরীরে পা দিয়ে আঘাত করে, কিল ঘুসি মারে। তারা ১৫০ টাকা স্ট্যাম্প দিয়ে আমাকে বলে তুই এখানে স্বাক্ষর কর, তুই মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচয় দিবি না, তুই কোনো দিন এলাকায় আসতে পারবি না। বিকাল ৫টার আগে বাড়ি থেকে না গেলে তোদের বাপ ছেলের শরীরে হাড় মাংস থাকবে না।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমি চাইলে শত কোটি টাকার মালিক হতে পারতাম। ২৩ বছর আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। আমি সারাজীবন সৎ জীবন যাপন করেছি। আওয়ামী লীগ আমলে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের অত্যাচারে নয় বছর বাড়িতে যেতে পারিনি। তিনি আমার নামে নয়টি মিথ্যামামলা দিয়েছেন। এর মধ্যে ছয়টি মামলায় আমি খালাস পেয়েছি। এখন আমার এমন অবস্থা যে, হাতে টাকাও নেই। ওই ঘটনার পর আমার বাড়িতেও কেউ নেই। টেস্ট করাবো কিভাবে বুঝতে পারছি না।’

আবদুল হাই কানু বলেন, ‘ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেলে টেস্ট করানোর সুযোগ পাবো। আমার এক এলাকার ছেলে মেডিকেলের কর্মচারী। সেও বললো যে, এইখানে এই ধরনের টেস্ট করানোর সুযোগ নেই। পরে ফিরে এসেছি।’

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেছিল কিনা জানতে চাইলে আবদুল হাই কানু বলেন, ‘না, কেউই যোগাযোগ করেনি। তবে চট্টগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান টেস্টগুলোর করানোর ব্যাপারে সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছে।’

২২ ডিসেম্বর দুপুরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানুর (৭৮) গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে রাতে ওই ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ছেড়ে যেতে বলছেন। এ সময় গ্রামবাসীর কাছে তাকে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও বলতে শোনা যায়।

কানু কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এ ছাড়া একই সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাবেক সহসভাপতি। তার পরিবারের অভিযোগ, লাঞ্ছনাকারীরা স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। আবদুল হাইকে এলাকাছাড়া করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কানুকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় গত ২৩ ডিসেম্বর দুই ‘সমর্থক’কে বহিষ্কার করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের বহিষ্কৃত সমর্থকেরা হলেন মু. আবুল হাশেম ও মু. অহিদুর রহমান।

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছনার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানান অনেকে। অনেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা মানববন্ধনও করেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানু আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের রোষানলে পড়ে প্রায় আট বছর এলাকায় আসতে পারেননি। আগস্টের গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজ এলাকা লুধিয়ারায় ফিরে গিয়েছিলেন।

গত ২৫ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা কানু নিজেই বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে ২৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, জুতার মালা পরানোয় ১০০ কোটি টাকার মানহানি এবং মারধরের অভিযোগে চৌদ্দগ্রাম থানায় মামলা করেন। মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে জামায়াত সমর্থক (বহিষ্কৃত) আবুল হাসেম ও অহিদুর রহমানকে। লাঞ্ছনার ঘটনায় ২৩ ডিসেম্বর রাতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পান এজাহারভুক্ত আসামি ইসমাইল হোসেন মজুমদার। বাকি চারজন আগেই জামিনে বেরিয়ে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই অভিযোগ করেছেন, মামলার প্রধান দুই আসামি বহিষ্কৃত জামায়াত সমর্থক আবুল হাশেম ও অহিদুর রহমানসহ অন্যান্য আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা বিভিন্নভাবে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm