মানুষের প্রথম ভাষাই হলো কান্না। নবজাতকের প্রথম চিৎকার থেকে শুরু করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস—প্রতিটি ক্ষণেই এই অশ্রুভাষা বয়ান করে ভালোবাসা, বেদনা, অনুশোচনা ও আশার গল্প। নবী-রাসুল ও সালাফে সালেহিনের জীবনে এই কান্নার রঙ ছিল আল্লাহমুখীতা ও তাকওয়ার আলোকচ্ছটা। আজ আমরা সাত ধরনের কান্নার সেই পথে ফিরে যাব, যেখানে প্রতিটি অশ্রু ফোঁটা জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার চাবিকাঠি। আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জন্য রয়েছে পরকালে মর্যাদাপূর্ণ স্থান ও সুখময় জান্নাত।
১. বিপদের কান্না
- মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া: ছোট-বড়, নারী-পুরুষ—সবার চোখেই বিপদের সময় অশ্রু জমে।
- রাসুলের (সা.) অশ্রু: ইবরাহিম (রা.)-এর মৃত্যুতে তিনি বলেন,
“চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে, হৃদয় ব্যথিত হয়। তবে আমরা তাই বলি—যার ওপর আমাদের সব সন্তুষ্টি।”
২. বিচ্ছেদের কান্না
- ইয়াকুব (আ.)-এর বুকফাটা আহাজারি: ইউসুফ (আ.)-এর বিচ্ছেদে তাঁর চোখের অবস্থা কোরআনে এভাবে বর্ণিত—
“আর তার চোখ দুটি কাঁপতে কাঁপতে সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।” (সুরা ইউসুফ : ৮৪)
৩. তিলাওয়াতের কান্না
- রাসুলের (সা.) নির্দেশ: “তোমরা কেঁদে কেঁদে কোরআন তিলাওয়াত করো। যদি কান্না না আসে, তবে কান্নার ভান ধরো।”
- সাহাবাদের অবস্থা: ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বর্ণনা করেন, কেউ কাঁদতেন, কেউ বেহুঁশ হয়ে যেতেন, কেউ আবার সেই বেহুঁশ অবস্থায় পরপারে পাড়ি জমাতেন।
৪. গুনাহের কথা স্মরণ করে কান্না
- আল্লাহর সন্তুষ্টি: যে ব্যক্তি নিজের গুনাহের কথা স্মরণ করে কাঁদে, আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।
- রাসুলের (সা.) ঘোষণা: “আল্লাহতাআলার কাছে দুই ফোঁটা অত্যন্ত প্রিয়—আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরে এবং আল্লাহর রাস্তায় যে অশ্রু ঝরে।”
৫. আল্লাহর ভয়ে কান্না
- ইমানের অপরিহার্য অংশ: “তারা আমাকে ডাকত আশা নিয়ে ও ভীত হয়ে। আর তারা ছিল আমার প্রতি বিনয়ী।” (সুরা আম্বিয়া : ৯০)
- একনিষ্ঠতার দলিল: আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত মুমিনের অন্তরের ঈমান ও তাকওয়ার বাস্তব প্রকাশ।
৬. শুকরিয়ার কান্না
- আনন্দাশ্রুও আল্লাহপ্রিয়: প্রিয়জন ফিরে পাওয়া বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে যে অশ্রু ঝরে, তাও আল্লাহর দরবারে মূল্যবান।
- হাশরের ময়দানে অমূল্য সম্পদ: এই অশ্রু বান্দার মুখে হাসি ফোটাবে এবং জান্নাতের পথ সহজ করে দেবে।
৭. সমস্যা সমাধানে কান্নামাখা দোয়া
- অদ্ভুত বাজার: ক্যারিয়ার, প্রেম, ব্যবসা—সবকিছুর সমাধানে মানুষ কোটি টাকা ঢালে, কিন্তু বিনামূল্যে রবের দরবারে কান্নার বাজার ঠান্ডা করে রাখে!
- দুঃখজনক বাস্তবতা: সব ক্ষমতার উৎস আল্লাহর কাছে না গিয়ে সৃষ্টির দ্বারে ঘোরা কি বোকামি নয়?
- সমাধানের একমাত্র ঠিকানা: “তিনি সব সমস্যার সমাধানকারী।” তাঁর দরবারে কান্নাকাটি করলেই প্রকৃত সুখ মিলবে।
জান্নাম থেকে মুক্তির একমাত্র পথ: অশ্রুর বরকত
- তিনটি চোখ জাহান্নাম দেখবে না:
- যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারাদারি করে
- যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে
- যে চোষ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ জিনিস দেখে ক্ষুব্ধ হয়
- আরশের ছায়া: “সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়া দান করবেন—তাদের একজন যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর চোখ থেকে পানি ঝরে।”
- দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না:
- যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে
- যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারায় রাতযাপন করে
আল্লাহর দয়া ও তওবার দরজা
- অনুশোচনার এক বিন্দু অশ্রু: আল্লাহ দয়ার সাগর; এক ফোঁটা অনুশোচনার অশ্রুতেই তিনি জীবনের সকল গুনাহ ধুয়ে দেন।
- ভুল ধারণা পরিহার: “আমরা অতি পাপী, আল্লাহ ক্ষমা করবেন না”—এ ভাবনা ভুল। তওবার দরজা সবসময় খোলা।
- রাসুলের (সা.) দোয়া: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই—এমন হৃদয় থেকে যা ভীত হয় না, এমন আত্মা থেকে যা তৃপ্ত হয় না।”
আমাদের প্রত্যাশা
আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বওয়া ও আল্লাহভীতি দান করুন—আমীন!